"

দুই ভাগ বিনিয়োগে সামিট পাচ্ছে ৮৬ ভাগ লাভ


গাজীপুরের কালিয়াকৈরে অবস্থিত হাইটেক পার্ক সিটির জমি ইজারা এবং প্রস্তুতকৃত স্থাপনা তৃতীয় পক্ষকে ভাড়া দিয়ে রাজস্ব আয় করছে সামিট টেকনোপলিশ লিমিটেড। তবে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে স্বাক্ষরিত এক অসম চুক্তির বলে এই আয়ের ৮৬ শতাংশ যাচ্ছে সামিটের পকেটে। অথচ ১০ বছর মেয়াদি চুক্তির ৯ বছর পেরিয়ে গেলেও বিনিয়োগ লক্ষ্যমাত্রার ২ শতাংশের কম বাস্তবায়ন করেছে সামিট টেকনোপলিশ। উপরন্তু অবকাঠামোগত স্থাপনা নির্মাণ হয়েছে লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ৪ শতাংশ। মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে পার্কের ৪৩ লাখ টাকার বেশি বিদ্যুৎ বিলও বকেয়া রেখেছে সামিট। সামিটের এমন অপেশাদারিত্বে রাষ্ট্রীয় অর্থের অপচয়, হাইটেক পার্ককে সফলভাবে কার্যকরে ব্যর্থতা এবং ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয়েছে বলে মনে করছে হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষ। অবশ্য গত ২৫ সেপ্টেম্বর চুক্তির শর্ত ভঙ্গের কারণ জানতে চেয়ে হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষ চিঠি দিলে খোঁড়া যুক্তি দেখায় সামিট। জানা যায়, ২০১৫ সালের ২৮ নভেম্বর পার্কের ২ এবং ৫ নম্বর ব্লকের ডেভেলপার হিসেবে সামিট টেকনোপলিশের সঙ্গে প্রাথমিকভাবে ১০ বছর মেয়াদি চুক্তি করে হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষ। এজন্য ব্লক-২-এ ৬২ একর এবং ব্লক-৫-এ ২৯ একরসহ মোট ৯১ একর জমি সামিটের অনুকূলে দেয় হাইটেক পার্ক। কালবেলার অনুসন্ধানে পাওয়া পৃথক দুটি চুক্তিপত্র অনুযায়ী, ব্লক-২-এ নির্মাণকৃত স্পেস তৃতীয় পক্ষকে ভাড়ায় দিয়ে প্রাপ্ত অর্থের মাত্র ১১ দশমিক ২৫ শতাংশ পাবে হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষ। বাকি প্রায় ৯০ শতাংশই যাবে সামিটের পকেটে। এই ব্লকের জমি তৃতীয় পক্ষকে ইজারা দিলে হাইটেক পার্ক পাবে ২৩ শতাংশ। আর ইজারা বাবদ আয়ের ৭৭ শতাংশই থাকবে সামিটের কাছে। ইউটিলিটি বিল এবং অন্যান্য খাত থেকে আয়ের মাত্র ৪ শতাংশ পাবে হাইটেক পার্ক এবং বাকিটা সামিটের। ব্লক-৫-এর ক্ষেত্রে রেভিনিউ শেয়ারিং হিসেবে হাইটেক পার্কের আয়ের অংশ আরও কম। ইউটিলিটি বিল এবং অন্যান্য খাত থেকে আয় অপরিবর্তিত থাকলেও প্রস্তুতকৃত স্পেস ভাড়ায় ১১ শতাংশ এবং জমির ইজারা থেকে ২২ শতাংশ পাবে হাইটেক পার্ক। অর্থাৎ এই দুই খাতে যথাক্রমে ৮৯ এবং ৭৮ শতাংশই যাবে সামিটের ভান্ডারে। এ ছাড়া হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষের কাছে আজ পর্যন্ত নিজেদের আয় গোপন রেখেছে সামিট। সামিটকে দেওয়া চিঠিতে হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষ জানায়, চুক্তির সাধারণ শর্তের আওতাধীন অনুচ্ছেদ ১.৮.৪ অনুযায়ী, প্রতি অর্থবছর শেষে অডিট রিপোর্ট দাখিলের উল্লেখ থাকলেও এখন পর্যন্ত কোনো অডিট রিপোর্ট দাখিল করেনি সামিট। ফলে সামিটের আয়ের সঠিক পরিমাণ হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষের পক্ষে জানা সম্ভব হয়নি। উপরন্তু প্রতি মাসের ১৫ তারিখের মধ্যে পূর্ব মাসের অর্জিত রাজস্ব থেকে হাইটেক পার্কের অংশ আনুপাতিক হারে পরিশোধের বিষয়টিও প্রতিপালন করেনি সামিট।


এখানেই শেষ নয়। চুক্তিতে তার চেয়েও বেশি ক্ষতিকর দিক রয়েছে। চুক্তিতে নিজেদের ওপর অর্পিত দায়িত্বের প্রায় কিছুই করেনি সামিট। চুক্তিপত্রের উপ-অনুচ্ছেদ ২.১.৩ অনুযায়ী, ব্লক-২ এবং ৫-এ যথাক্রমে ১১৪ দশমিক ৫৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং ৯৩ দশমিক শূন্য ৩ মিলিয়নসহ মোট ২০৭ দশমিক ৫৯ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের শর্ত ছিল সামিটের। চুক্তি স্বাক্ষর-পরবর্তী ১০ বছরের মধ্যে এই বিনিয়োগ সুরক্ষিত করতে হতো প্রতিষ্ঠানটিকে। ডলারের বিপরীতে বাংলাদেশি মুদ্রার মান ১০০ টাকা বিবেচনা করলে সামিটকে ২ হাজার ৭৫ কোটি ৯০ লাখ টাকা বিনিয়োগ করতে হতো। অথচ চুক্তি স্বাক্ষরের ৯ বছর পেরিয়ে গেলেও দুই ব্লকে সামিট মাত্র ৩৭ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে বলে দাবি হাইটেক পার্কের। সেই হিসাবে বিনিয়োগ লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ১ দশমিক ৭৮ শতাংশ বাস্তবায়ন হয়েছে। যদিও শর্ত ভঙ্গের কারণ ব্যাখ্যা করে হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষকে দেওয়া নিজেদের চিঠিতে ৭৫ কোটি ২২ লাখ টাকা বিনিয়োগের দাবি করেছে সামিট। দাবিটি আমলে নিলেও বিনিয়োগ বাস্তবায়নের হার সাড়ে তিন শতাংশের কিছু বেশি। এ ছাড়া বিনিয়োগকারীদের অনুকূলে বরাদ্দের লক্ষ্যে ১০ বছরের মধ্যে দুই ব্লকে ৪৭ দশমিক ২৮ লাখ বর্গফুট স্পেস নির্মাণ সম্পন্নের বাধ্যবাধকতা ছিল সামিটের। ব্লক-২ এবং ব্লক-৫-এ স্পেসের পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ২৪ দশমিক ২০ লাখ এবং ২৩ দশমিক শূন্য ৮ লাখ বর্গফুট। অথচ সামিট এখন পর্যন্ত মাত্র ২ দশমিক ২৫ লাখ বর্গফুট স্পেস নির্মাণ করেছে, যা লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ৪ দশমিক ৭৫ শতাংশ। নির্ধারিত সময়ে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী কাজ সম্পন্ন না হলে সামিট টেকনোপলিশকে দৈনিক আড়াই হাজার মার্কিন ডলার হারে হাইটেক পার্ককে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। বিষয়টি এখনো প্রতিপালিত হয়নি মর্মে চিঠিতে সামিটকে জানিয়েছে হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষ।
গত ১৭ অক্টোবর হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষের চিঠির জবাব দেয় সামিট টেকনোপলিশ। ৮ পাতার দীর্ঘ ফিরিস্তিতে শর্ত পালনের ব্যর্থতা হিসেবে এক প্রকার হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষকেই দায়ী করে প্রতিষ্ঠানটি। হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষের ঘোষিত বিভিন্ন সুবিধা না পাওয়া, কর রেয়াতি সুবিধা না পাওয়া, কভিড-১৯ করোনা প্রাদুর্ভাব, দেশে আরও অর্থনৈতিক অঞ্চল থাকা, প্রাইভেট হাইটেক পার্ক থাকার মতো অজুহাতকে কারণ হিসেবে দেখানো হয় প্রতিষ্ঠানটির ডিরেক্টর ইনচার্জ রাহাদ হোসেন স্বাক্ষরিত চিঠিতে। পাশাপাশি হাইটেক পার্কের সঙ্গে রেভিনিউ শেয়ারিং ব্যর্থতার জন্য আর্থিক ক্ষতির অজুহাত দিয়েছে সামিট। চিঠিতে সামিট উল্লেখ করে, ‘হাইটেক পার্কের ডেভেলপার হিসেবে প্রচুর আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছি। হাইটেক পার্কে বিনিয়োগকৃত অর্থের ওপর প্রতি মাসে সুদ হয় ৭৫ লাখ টাকার বেশি। কিন্তু প্রতি মাসে হাইটেক পার্ক থেকে আমাদের আয় অর্ধেকেরও অনেক কম। উপরন্তু, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা এবং প্রতিনিয়ত ভবন, সাব-স্টেশনের রক্ষণাবেক্ষণ সংক্রান্ত ব্যয়ের কারণে আমরা সময়মতো রেভিনিউ শেয়ার করতে পারিনি।’


পরিচয় গোপন রাখার শর্তে হাইটেক পার্কের এক কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের মদদে এবং তৎকালীন আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকের সরাসরি হস্তক্ষেপে সামিট টেকনোপলিশের সঙ্গে এমন অসম চুক্তি করে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাটি। এই চুক্তির মাধ্যমে হাইটেক পার্ককে নামমাত্র মুনাফা দিয়ে সিংহভাগই নিজেদের করে নেয় সামিট। হাইটেক পার্কের সঙ্গে সামিটের এই চুক্তিকে অসম হিসেবে অভিহিত করেছেন দেশীয় তথ্যপ্রযুক্তি খাত সংশ্লিষ্টরা। তথ্যপ্রযুক্তি খাতের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বেসিসের সাবেক সভাপতি এবং পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের টেকসই উন্নয়ন সংক্রান্ত টাস্কফোর্সের সদস্য ফাহিম মাশরুর কালবেলাকে বলেন, বিগত সরকার প্রায় সব ক্ষেত্রেই নিজেদের পছন্দের গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষার্থে এভাবে অসম চুক্তি করেছে, সেটা জ্বালানি হোক, প্রযুক্তি বা হাইটেক পার্কের প্রকল্প হোক। হাইটেক পার্কের স্থাপনাগুলোতে সামিট এবং ডিজিকনের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোকে কোনো নিয়মনীতি ছাড়াই বাড়তি সুবিধা দেওয়া হয়েছে। তাদের ছাড়াও কিন্তু দেশে আরও প্রতিষ্ঠান ছিল। সামিটের সঙ্গে হাইটেক পার্কের ১০ বছরের চুক্তির মেয়াদ শেষ হলে জমি লিজ দেওয়ার বিষয়টি বাদ দিতে হবে। আর যেসব স্থাপনা সামিট নির্মাণ করেছে, ভাড়া নিচ্ছে, সেখানে রেভিনিউ শেয়ারিংয়ের নতুন হার নির্ধারণ করে চুক্তি করতে হবে।


চুক্তির বিষয়ে জানতে চাইলে হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) একেএম আমিরুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, ‘সামিটের সঙ্গে চুক্তিটি পর্যালোচনায় কমিটি কাজ করছে। কমিটির চূড়ান্ত মতামতের ভিত্তিতে পরবর্তী সময়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তার আগে চুক্তিটিকে এখনই ‘অসম’ বলতে পারছি না। তবে সাধারণ জনমত হচ্ছে চুক্তিটি ‘অসম’ ছিল।’
Previous Post Next Post

Random Manga

Ads

نموذج الاتصال