বৈদেশিক সাহায্যপুষ্ট একটি প্রকল্প নিরীক্ষার জন্য সারা দেশের উপজেলা কৃষি কর্মকর্তাদের কাছ থেকে ঘুষ নিয়েছেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। অনেকটা নিরুপায় হয়ে এই কর্মকর্তারা ঘুষ দেন। বিষয়টি প্রকাশ পাওয়ার পর চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয় কৃষি মন্ত্রণালয়সহ অধিদপ্তরে। গঠিত হয় তদন্ত কমিটি। কমিটির দীর্ঘ অনুসন্ধানে ঘুষ গ্রহণের সত্যতাও পাওয়া যায়। ঘুষ গ্রহণকারী আলোচিত ওই কর্মকর্তা হলেন অধিদপ্তরের ন্যাশনাল এগ্রিকালচারাল টেকনোলজি প্রোগ্রাম (এনএটিপি) ফেজ-২ প্রকল্পের সাবেক পরিচালক ড. মো. সাখাওয়াত হোসেন শরীফ।
জানা যায়, ২০১৭ সালে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের আওতায় চালু হয় ন্যাশনাল এগ্রিকালচারাল টেকনোলজি প্রোগ্রাম (এনএটিপি) ফেজ-২। গত বছর প্রকল্পটির বাস্তবায়ন শেষ হয়। শেষ বছরের মাঝামাঝি প্রকল্প পরিচালক প্রকল্পের হিসাব নিরীক্ষার নামে সারা দেশের ২৭০ উপজেলা কর্মকর্তাদের কাছে একটি লিখিত চিঠি দেন। চিঠিতে তিনি উল্লেখ করেন, ‘২০২২-২৩ অর্থবছরের হিসাব নিরীক্ষা কার্যক্রম ৩১ অক্টোবর থেকে ১৯ নভেম্বরের মধ্যে অডিট অধিদপ্তরের মাধ্যমে সম্পন্ন করা হবে।’ এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র খামারবাড়িতে পাঠানোর অনুরোধ করা হয়।
তবে কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে তখন মেলে ভিন্ন তথ্য। কাগজপত্র সংগ্রহের নামে কর্মকর্তাদের কাছে ঘুষ দাবি করা হয়। বলা হয়, অডিট ঠিকঠাক সম্পন্ন করতে টাকার প্রয়োজন। আদতে কোনো অডিট করা হয়নি। বিষয়টি আমলে নিয়ে চলতি বছরের ১৭ জুলাই তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। এতে সদস্য করা হয় উদ্ভিদ সংগনিরোধ উইংয়ের অতিরিক্ত পরিচালক ড. মো. হযরত আলী, উপপরিচালক (রপ্তানি) ড. মো. মফিজুল ইসলাম এবং উপপরিচালক (ডিপ্লোমা এডুকেশন) মো. মনিরুল ইসলামকে। এই কমিটি দীর্ঘ তদন্ত করে প্রমাণ পায় আর্থিক লেনদেনের।
গত সোমবার তদন্ত কমিটির জমা দেওয়া রিপোর্টের কপি কালবেলার হাতে এসেছে। এতে বলা হয়েছে, সরেজমিন তদন্তকাজ চলাকালীন কমিটির সদস্য ড. মো. মফিজুল ইসলামের বদলিজনিত কারণে তার পরিবর্তে উপপরিচালক (রপ্তানি) হাসান ইমামকে কমিটির সদস্য করা হয় এবং তদন্তকাজ পরিচালনা করা হয়।
তদন্তের জন্য সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের অতিরিক্ত পরিচালক, জেলার উপপরিচালক, উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ও সমাপ্ত এনএটিপি-২-এর হিসাব ও অডিট কাজের জড়িতদের সঙ্গে আলাপ করা হয়। সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের অতিরিক্ত পরিচালক এবং জেলার উপপরিচালকদের চিঠি দেওয়া হয় এবং সহযোগিতার জন্য সংশ্লিষ্ট উপজেলা কৃষি কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দেওয়ার জন্য অনুরোধ করা হয়। অতঃপর তদন্ত কমিটি সংশ্লিষ্ট জেলা ও উপজেলায় গিয়ে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ও তাদের অফিসের হিসাব সংরক্ষণের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের সাক্ষাৎকার ও লিখিত বক্তব্য নেয়।
তদন্ত রিপোর্টে বলা হয়, তদন্তের নামে উপজেলা থেকে বিভিন্ন ডকুমেন্ট প্রকল্প অফিসে এনে কোনো ধরনের অডিট না করে তা উপজেলায় ফেরত পাঠানোর ব্যাপারটা আর্থিক লেনদেনের সন্দেহ সৃষ্টি করে। প্রকল্প অফিসে অডিট সম্পাদন না করেই অনেক উপজেলা থেকে অডিট খরচের নামে বরাদ্দকৃত টাকার দুই শতাংশ হারে আদায় করা হয়। উপজেলা কৃষি অফিস থেকে অডিটের নামে টাকা সংগ্রহে প্রকল্প অফিসের একটি সংঘবদ্ধ চক্র কাজ করে।
এতে আরও বলা হয়, সার্বিক কার্যক্রম বিবেচনায় বলা যায়, ড. মো. সাখাওয়াত হোসেন শরীফ, প্রাক্তন পরিচালক, এনএটিপি ফেজ-২ প্রকল্পের (সমাপ্ত) বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে এবং তার নেতৃত্বে প্রকল্প অফিস থেকে দুর্নীতির উদ্দেশ্যে ভুয়া অডিটের ব্যবস্থা করা হয়; কিন্তু কোনো অডিট কার্যক্রম সম্পন্ন করা হয়নি।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে ড. মো. সাখাওয়াত হোসেন শরীফ কালবেলাকে বলেন, ‘টাকা আদায়ের অভিযোগ মিথ্যা। এ ধরনের কোনো ঘটনা ঘটেনি। একটি চক্র আমাকে বিতর্কিত করতে নানাভাবে চেষ্টা করছে।’ এ বিষয়ে তদন্ত কমিটির সদস্য এবং উদ্ভিদ সংগনিরোধ উইংয়ের উপপরিচালক ড. মো. হযরত আলী কালবেলাকে বলেন, ‘যথাযথ তদন্ত করেছি, যা পেয়েছি তার ভিত্তিতে প্রতিবেদন তৈরি করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দিয়েছি। তারা এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেবে।’
Tags
সারাদেশ