"

যত বেশি শিক্ষা তত বেশি বেকার


বাংলাদেশে একটি বহুল প্রচলিত প্রবাদ ‘লেখাপড়া করে যে, গাড়ি ঘোড়া চড়ে সে’। ছোটবেলায় সন্তানদের পড়াশোনার প্রতি উৎসাহিত করতেই মূলত এ ধরনের কথা বলা হতো। কিন্তু বাংলাদেশের চিত্র পুরো উল্টো। বর্তমানে বাংলাদেশে যারা বেশি পড়াশোনা করেন, তাদের মধ্যেই বেকারত্বের হার সবচেয়ে বেশি। অর্থাৎ বাস্তবতা বলছে, যত বেশি শিক্ষা তত বেশি বেকার। সরকারি সংস্থার জরিপ প্রতিবেদন পর্যালোচনায় এমন তথ্য পাওয়া যায়।


বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ জরিপ প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষিত বেকারের হার সবচেয়ে বেশি। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেকার মাধ্যমিক পাস করা শিক্ষার্থীরা। এর পরই রয়েছে উচ্চমাধ্যমিক সম্পন্নকারী এবং প্রাথমিকের গণ্ডি পেরোনো। বেকারত্বের হার সবচেয়ে কম অশিক্ষিতদের মধ্যে। অর্থাৎ যারা পড়াশোনা করেনি, তাদের মধ্যে বেকার মানুষ কম।


সম্প্রতি শ্রমশক্তি জরিপ-২০২৩-এর পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বিবিএস। সেই প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, বর্তমানে বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যা ১৭ কোটি ১৭ লাখ ১০ হাজার। এর মধ্যে ১৫ বছর এবং তদূর্ধ্ব বয়সী বেকার জনসংখ্যা ২৪ লাখ ৬০ হাজার। অর্থাৎ ৩ দশমিক ৩৫ শতাংশ মানুষ বেকার। যারা কর্মক্ষম, কিন্তু গত এক বছরে চেষ্টা করেও কোনো কাজের সুযোগ পায়নি।


আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) সংজ্ঞা অনুযায়ী, যারা কর্মক্ষম এবং কোনো কাজে নিয়োজিত নয়, নির্দিষ্ট সময়ে কাজ খুঁজে বেড়ায় এবং ওই সময়ে কাজের সুযোগ পেলে সে কাজ করতে বা যোগদানে প্রস্তুত থাকে, মূলত সেসব ব্যক্তিকে বেকার হিসেবে ধরা হয়। বিবিএসও এই সংজ্ঞা ব্যবহার করে বেকারের তথ্য নির্ণয় করেছে।


বিবিএসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের মোট বেকার জনগোষ্ঠীর মধ্যে ১৯ লাখ ৪০ হাজার যুবক বেকার। যার মধ্যে প্রায় ৮ লাখ উচ্চশিক্ষিত। অর্থাৎ মোট বেকার জনগোষ্ঠীর প্রায় এক-তৃতীয়াংশই উচ্চশিক্ষিত, যারা স্নাতক থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন।


প্রতিবেদনের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, দেশের মোট বেকার মানুষের ৩১ দশমিক ৫০ শতাংশই উচ্চশিক্ষিত। অথচ যাদের আনুষ্ঠানিক শিক্ষা নেই বা পড়াশোনা করেনি, তাদের বেকারত্বের হার মাত্র ১ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ। অর্থাৎ মানসম্মত শিক্ষার অভাবে দেশে বেকারত্বের হার বাড়ছে, বিশেষ করে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা অধিক হারে বাড়ছে।


বিবিএসের তথ্যে দেখা যায়, উচ্চমাধ্যমিক পাস করা বেকারের হার ১৪ দশমিক ৮৭ শতাংশ, মাধ্যমিক শেষ করা বেকার ২১ দশমিক ২৯ শতাংশ। প্রাথমিকের গণ্ডি পেরোনো বেকারের হার ৮ দশমিক ৭ শতাংশ। অন্য কোনো মাধ্যমে শিক্ষা গ্রহণ করা ব্যক্তিদের বেকারত্বের হার শূন্য দশমিক ৮১ শতাংশ।


প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, উচ্চশিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বাড়ছে। শ্রমশক্তি জরিপ-২০২২ এর হিসাবে দেশে উচ্চশিক্ষিত বেকার ছিল মোট বেকার জনগোষ্ঠীর ২৭ দশমিক ৮ শতাংশ, যা বছরের ব্যবধানে বেড়ে হয়েছে ৩১ দশমিক ৫০ শতাংশ। বছরের ব্যবধান উচ্চশিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ৪ শতাংশ। অর্থাৎ ধারাবাহিকভাবেই বাড়ছে উচ্চশিক্ষিত বেকার মানুষের সংখ্যা।


গ্রামের চেয়ে শহরে উচ্চশিক্ষিত বেকারের হার বেশি। প্রতিবেদন অনুযায়ী, শহরের উচ্চশিক্ষিত বেকারের হার ৩৪ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ, সেখানে গ্রামের বেকার ৩০ দশমিক ২৫ শতাংশ। একইভাবে পুরুষের চেয়ে উচ্চশিক্ষিত নারী বেকারের হার বেশি। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৩ সালে ৩৮ দশমিক ৩৪ শতাংশ উচ্চশিক্ষিত নারী এবং ২৮ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ পুরুষ বেকার ছিল।


শ্রমশক্তি জরিপের তথ্য অনুযায়ী, একদিকে দেশে পুরুষ বেকারের সংখ্যা বাড়ছে, অন্যদিকে কমছে নারী বেকারের সংখ্যা। মোট বেকার জনসংখ্যার মধ্যে পুরুষ রয়েছে ১৬ লাখ ৪০ হাজার, যেখানে বেকার নারী ৮ লাখ ২০ হাজার। দেশে বেকারত্বের হার ৩ দশমিক ৩৫ শতাংশ। ১০ বছরে বাংলাদেশের বেকারত্বের হার ৪ দশমিক ৩ শতাংশ থেকে কমে হয়েছে ৩ দশমিক ৫ শতাংশ। নারীদের বেকারত্বের হার ৩ দশমিক ২৩ শতাংশ, আর পুরুষদের বেকারত্বের হার ৩ দশমিক ৪১ শতাংশ।


১০ বছরের প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০১৩ সালে দেশে পুরুষ বেকারের সংখ্যা ছিল ১৩ লাখ। ২০২৩ সালে সেটা বেড়ে হয়েছে ১৬ লাখ ৪০ হাজার। অর্থাৎ ১০ বছরের ব্যবধানে পুরুষ বেকারের সংখ্যা বেড়েছে ৩ লাখ ৪০ হাজার। তবে একই সময়ে নারী বেকারের সংখ্যা কমেছে ৪ লাখ ৮০ হাজার। ২০১৩ সালে পুরুষের সমান ১৩ লাখ নারী বেকার ছিল। ২০২৩ সালে সেটা কমে হয়েছে ৮ লাখ ২০ হাজার।


গত ১০ বছরের হিসাবে শহরের চেয়ে গ্রামে বেকার মানুষের সংখ্যা বেড়েছে। ২০১৩ সালে গ্রামে বেকার মানুষ ছিল ১৬ লাখ। ২০২৩ সালে সেটা বেড়ে হয়েছে ১৬ লাখ ৬০ হাজার। অর্থাৎ ১০ বছরে গ্রামে বেকার বেড়েছে ৬০ হাজার। বিপরীতে শহরে একই সময়ে বেকার কমেছে ২ লাখ। ২০১৩ সালে যেখানে শহরের বেকারের সংখ্যা ছিল ১০ লাখ, সেখানে ২০২৩ সালে কমে হয়েছে ৮ লাখ।


বিবিএসের সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপের হিসাব বলছে, দেশের মোট শ্রমশক্তি ৭ কোটি ৩৪ লাখ ৫০ হাজার। এর মধ্যে পুরুষ ৪ কোটি ৮১ লাখ ২০ হাজার এবং নারী ২ কোটি ৫৩ লাখ ৩০ হাজার। মোট শ্রমশক্তির মধ্যে কর্মে নিয়োজিত রয়েছেন ৭ কোটি ৯ লাখ ৮০ হাজার জন। সেই হিসাবে দেশে কর্মক্ষম বেকারের সংখ্যা ২৪ লাখ ৭০ হাজার।


জরিপে ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সীদের যুব হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। জরিপের ফল অনুযায়ী, ২০২৩ সালে দেশে মোট যুব শ্রমশক্তি ২ কোটি ৬৭ লাখ ৬০ হাজার। এ যুব জনগোষ্ঠীর মধ্যে পুরুষ ১ কোটি ৩৬ লাখ আর নারী ১ কোটি ৩১ লাখ ৬০ হাজার। এতে উঠে এসেছে, মোট শ্রমশক্তির মধ্যে যুব শ্রমশক্তি ৩৬ দশমিক ৪৪ শতাংশ। যুব শ্রমশক্তি গ্রাম এলাকায় ৩৮ দশমিক ৬৪ শতাংশ এবং শহর এলাকায় ৩০ দশমিক ১২ শতাংশ।


যুব শ্রমশক্তির মধ্যে ২ কোটি ৪৮ লাখ ২০ হাজার যুব কর্মে নিয়োজিত ছিল, যাদের মধ্যে পুরুষ ১ কোটি ২৩ লাখ ও নারী ১ কোটি ২৫ লাখ ৩০ হাজার। যুব শ্রমশক্তির মধ্যে ২৪ লাখ ৬০ হাজার যুব বেকার, যেখানে পুরুষ ১৬ লাখ ৪০ হাজার এবং নারী ৮ লাখ ২০ হাজার।


এ বিষয়ে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. মনজুর আহমেদ কালবেলাকে বলেন, বেকারত্বের সংজ্ঞার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করে। বিবিএস বেকারত্বের যে হিসাব দেয়, তা সঠিক নয়। একজন মানুষের জীবনধারণের জন্য যতটুকু আয় দরকার হয় সেটা তার আছে কি না, এটিসহ বেশকিছু তথ্য বিবিএসের জরিপে আসে না। সে কারণে দেশের বেকারত্ব সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যায়, কিন্তু প্রকৃত চিত্র পাওয়া যায় না।


উচ্চশিক্ষিতদের বেকার থাকার বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্স বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, আমরা যে পরিমাণ গ্র্যাজুয়েট তৈরি করছি, সে পরিমাণে জব তৈরি করতে পারছি না। জব তৈরি হওয়ার জন্য যে পরিমাণ বিনিয়োগ দরকার, তা হচ্ছে না। জব তৈরি না হলে তো উচ্চশিক্ষিতরা বেকার থাকবেই। পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যারা পড়াশোনা শেষ করে, তারা ভালো জব পেতে অপেক্ষা করে, এটাও বেকার থাকার একটি কারণ। এ ছাড়া মার্কেটের চাহিদা অনুযায়ী যে দক্ষ গ্র্যাজুয়েট তৈরি করার কথা সেটা আমরা করতে পারছি না। মানসম্মত শিক্ষাও দিতে পারছি না। ফলে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে বেকারত্ব বাড়ছে।

 
Previous Post Next Post

Random Manga

Ads

نموذج الاتصال