চলতি ডিসেম্বর মাসে অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় ব্যাংকের মাধ্যমে বেশি রেমিট্যান্স আসছে। রপ্তানি আয়ও আসছে বেশি পরিমাণে। এর পরও দেশের ব্যাংকগুলোয় ডলারের সংকট তীব্র হয়ে উঠেছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে বাড়তি দামে রেমিট্যান্সের ডলার কিনছে বেশিরভাগ ব্যাংক। ব্যাংকের পাশাপাশি খোলা বাজারেও (কার্ব মার্কেটে) ডলারের দাম বেড়েছে। সব মিলিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পর চার মাস ডলারের বাজার স্থিতিশীল থাকলেও গত ১৫ দিনে তা ফের অস্থিতিশীল হয়ে উঠেছে।
এদিকে, বাজার নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংক বেশকিছু উদ্যোগ নিয়েছে। এরই অংশ হিসেবে গত মঙ্গলবার ব্যাংকগুলোকে ১২৩ টাকার বেশি দরে রেমিট্যান্স না কেনার নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতেও ৩ টাকা দর বাড়িয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কেননা, এতদিন ঘোষিত দর অনুযায়ী প্রতি ডলারের বিনিময় হার সর্বোচ্চ হওয়ার কথা ছিল ১২০ টাকা। সেইসঙ্গে বেশি দরে রেমিট্যান্স কেনা ১৩টি ব্যাংকের কাছে ব্যাখ্যা তলব করেছে নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি।
বাংলাদেশ ব্যাংক নানামুখী তৎপরতার কথা বললেও ডলারের দর পুরোপুরি বাজারভিত্তিক না করলে ডলারের দর স্থিতিশীল হবে না বলে জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা। তাদের মতে, মূলত দুটি কারণে ডলারের দর বাড়ছে। প্রথমত, বাস্তবতার কারণে ডলারের চাহিদা বেড়েছে। দ্বিতীয়ত, ডলারের দর বাজারভিত্তিক করা নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সিদ্ধান্তহীনতা।
জানা গেছে, রমজান কেন্দ্র করে ভোগ্যপণ্য আমদানির গতি বেড়েছে। এতে আমদানি দায় পরিশোধের চাহিদাও বেড়েছে। আবার বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে ওভারডিউ (বকেয়া) হয়ে যাওয়া সব ঋণপত্রের (এলসি) দায় ডিসেম্বরের মধ্যে পরিশোধের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ কারণে কিছু ব্যাংক বেশি দামে ডলার কিনে হলেও এলসি দায় সমন্বয় করছে। অন্যদিকে, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত অনুযায়ী বছরের শেষে নির্ধারিত পরিমাণে রিজার্ভ সংরক্ষণ করতে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে ডলার কেনা বাড়িয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ ছাড়া আইএমএফের ঋণের চতুর্থ কিস্তি ছাড়ের আগে যে দলটি সম্প্রতি বাংলাদেশ ভিজিট করেছে, তারা লিখিত বক্তব্যে বলেছেন যে, বাংলাদেশকে তারা নতুন করে ঋণ দিতে চায়। তবে ডলারের দরকে পুরোপুরি বাজারভিত্তিক করাসহ বেশকিছু শর্ত দিয়েছে। এর ফলে বাংলাদেশ ব্যাংকও বলেছে ডলারের দরকে বাজারভিত্তিক করা হবে। কিন্তু কোন পদ্ধতিতে বা কীভাবে করা হবে সে নির্দেশনা বাংলাদেশ ব্যাংক এখনো দেয়নি। আর বাংলাদেশ ব্যাংকের সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্তের অভাবেই কিছু ব্যাংক আগে থেকেই ডলারের দর বাড়িয়ে দিয়েছে।
বিশ্বব্যাংকের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন কালবেলাকে বলেন, সম্প্রতি ডলারের চাহিদা বেড়েছে, এটা সত্য। তবে চাহিদা বাড়া ছাড়াও ডলারের দর বাড়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে অতীতের ভুল নীতির ফল। আগের সরকারের সময়ে ডলারের দরকে বাজারের ওপর ছেড়ে না দিয়ে ধরে রাখা হয়েছিল। এ কারণে দেশের রিজার্ভের ক্ষয় হয়েছে, টাকার রেকর্ড অবমূল্যায়ন ঘটেছে, মূল্যস্ফীতি উসকে উঠেছে। ভুল নীতির কারণে দেশের মানুষ ও অর্থনীতি বিপদে পড়েছে। রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি না করে বিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়ে দিলে সাময়িকভাবে দর বাড়ত। কিন্তু ধীরে ধীরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে এলে দর সংশোধন হতো।
তিনি বলেন, ডলার দরকে বাজারভিত্তিক করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক এখনো আগের নীতিতেই রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক এখনো আগের নিয়মেই অর্থাৎ ক্রলিং পেগের মাধ্যমেই ডলারের দর নির্ধারণ করা হচ্ছে। যদিও আইএএমএফের চাওয়া অনুযায়ী, বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের দর নির্ধারণ বাজারভিত্তিক করার কথা বলেছে; কিন্তু সেটা এখনো করেনি। ফলে এ সুযোগে কিছু ব্যাংক ধরেই নিয়েছে, এতে ডলারের দর বাড়বে। তাই তারা আগে থেকেই বাড়তি দরে ডলার কেনা শুরু করেছে। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংককে এখন অতীতের বকেয়া এলসি দায়সহ অন্যান্য দায়ও পরিশোধ করতে হচ্ছে। পাশাপাশি ভোগ্যপণ্যসহ বিভিন্ন পণ্যের এলসি খোলা বাড়ছে। এ কারণে ডলারের চাহিদা বাড়ছে। তবে রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয়ের প্রবৃদ্ধির কারণে ডলারের জোগানও বেড়েছে। আগামী তিন মাসের মধ্যে বিশ্বব্যাংক, এডিবি, আইএমএফসহ দাতা সংস্থাগুলোর কাছ থেকে ২-৩ বিলিয়ন ডলার ঋণ সহায়তা পাওয়া যাবে। এসব ডলার যোগ হলে সংকট অনেকাংশেই কেটে যাবে। এজন্য ক্রলিং পেগ নীতি থেকে বেরিয়ে ডলারকে অতি সত্বর বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া দরকার।
একই বিষয়ে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, ব্যাংকগুলোতে এখন ডলারের চাহিদা বেশ বেড়েছে। ফলে অনেক ব্যাংক বাড়তি প্রণোদনা দিয়ে রেমিট্যান্স সংগ্রহ করছে। এ ছাড়া, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে ওভারডিউ হয়ে যাওয়া সব ঋণপত্রের (এলসি) দায় ডিসেম্বরের মধ্যে পরিশোধের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ কারণে কিছু ব্যাংক বেশি দামে ডলার কিনে হলেও এলসি দায় সমন্বয় করছে। এর পাশাপাশি পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ায় নভেম্বর-ডিসেম্বরে জ্বালানি তেল-এলএনজিসহ বেশকিছু বড় এলসি খেলা হয়েছে। আবার আসন্ন রমজান কেন্দ্র করে ভোগ্যপণ্যের এলসি খোলাও বেড়েছে। এসব কারণে ডলারের দর এখন ঊর্ধ্বমুখী। তবে চাহিদার পাশাপাশি ডলারের জোগান বাড়ায় দামও অনেকাংশে কমে এসেছে।
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর দেশে অব্যাহতভাবে বাড়তে থাকে রেমিট্যান্স প্রবাহ। আর অস্থিতিশীল পরিস্থিতির কারণে আমদানিতেও ধীরগতি দেখা গেছে। ফলে ডলারের বাজার অনেকটাই স্থিতিশীল হয়ে এসেছিল। ব্যাংকের পাশাপাশি কার্ব মার্কেটেও ডলারের দর ছিল নিম্নমুখী। চাহিদা কমে যাওয়ায় কার্ব মার্কেটে প্রতি ডলারের বিনিময় হার ১২১ টাকায় নেমে গিয়েছিল; কিন্তু চাহিদা বাড়ায় নভেম্বর মাস থেকেই ডলারের দর বাড়তে শুরু করেছে।
এর আগে, তিন বছর ধরে ডলারের বাজার স্থিতিশীল করার কথা বলে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। প্রথমে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করে বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখার চেষ্টা করা হয়। এরপর ধীরে ধীরে অবমূল্যায়ন ঘটানো হয় টাকার। নিয়ন্ত্রিত কোনো পদ্ধতিই কাজ না করায় শুরু হয় ‘ক্রলিং পেগ’ নীতির বাস্তবায়ন। কিন্তু এ সময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কোনো নীতিই ডলারের বাজারকে স্থিতিশীল করতে পারেনি। প্রায় ৫০ শতাংশ অবমূল্যায়নের পরও পতন থামেনি টাকার।
Tags
জাতীয়