"

ঢাকার মামলা ফাইলবন্দি, কলকাতায় শুনানি শুরু


ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনার হত্যার ঘটনায় দুটি মামলা হয়েছে। একটি কলকাতায়, অন্যটি ঢাকায়। কলকাতার মামলাটি প্রাথমিক তদন্ত শেষে আদালতে অভিযোগপত্র দিয়েছে সেখানকার সিআইডি। এদিকে ঢাকার মামলায় গত ৫ আগস্টের পর কোনো অগ্রগতি হয়নি। ফাইলবন্দি হয়ে আছে মামলাটি। একের পর এক তদন্ত কর্মকর্তা পরিবর্তনের মধ্যেই আটকে আছে ঢাকার তদন্ত।


ঢাকার শেরেবাংলা নগর থানায় করা মামলাটি তদন্ত করছে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) ওয়ারী বিভাগ। কয়েক মাসের ব্যবধানে তৃতীয় কর্মকর্তা হিসেবে মামলাটি তদন্ত করছেন ওয়ারী বিভাগের সহকারী কমিশনার তানভীর হাসান। এর আগে একজন সহকারী কমিশনার ও একজন অতিরিক্ত উপকমিশনার মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।


মামলার অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে সহকারী কমিশনার তানভীর হাসান কালবেলাকে বলেন, নতুন করে কোনো অগ্রগতি নেই। আমি নতুন দায়িত্ব পেয়েছি। আগে যারা গ্রেপ্তার ছিলেন, তারা কারাগারে আছেন।


এদিকে আনারের মরদেহের খণ্ডাংশ শনাক্তকরণের জন্য ডিএনএ পরীক্ষার নমুনা দিয়েছেন তার মেয়ে মুমতারিন ফেরদৌস ডরিন। নভেম্বর মাসের শেষ দিকে কলকাতায় নমুনা দেন তিনি। এর আগে গত আগস্টে উত্তর চব্বিশ পরগনার বারাসাত জেলা আদালতে প্রায় ১২শ পাতার অভিযোগপত্র জমা দিয়েছে কলকাতা সিআইডি। এরই মধ্যে মামলার বিচারকাজ শুরু হয়েছে।


গতকাল মঙ্গলবার রাতে কলকাতা সিআইডির তদন্ত কর্মকর্তা কৌশিক কালবেলাকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, নভেম্বরের শেষে ডিএনএ নমুনা দিয়েছেন ডরিন। তবে এখনো রিপোর্ট পাওয়া যায়নি। আমরা এরই মধ্যে আদালতে চার্জশিট দিয়েছি। আমাদের এখানে গ্রেপ্তার দুজন কারাগারে আছে। আদালতে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের শুনানি শুরু হয়েছে। চলতি মাসেও আরেকটি শুনানি আছে।


চলতি বছরের ১২ মে সীমান্তপথে কলকাতায় গিয়ে বন্ধু গোপালের বাসা ওঠেন এমপি আনার। পরদিন ১৩ মে চিকিৎসার কথা বলে বাসা থেকে হন। কিন্তু এর পর থেকে তার সঙ্গে পরিবার ও গোপালের যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। আনারের কোনো সন্ধান না পেয়ে ১৮ মে কলকাতার বারানগর পুলিশ স্টেশনে একটি সাধারণ ডায়েরি করেন গোপাল। এদিকে ডিএমপি ডিবিকেও নিখোঁজের বিষয়টি জানানো হয়। তদন্ত করে ২৩ মে ঢাকা থেকে শিমুল, তানভীর ও শিলাস্তিকে গ্রেপ্তার করে ডিবি ওয়ারী বিভাগ। পরে একে একে আরও চারজন গ্রেপ্তার হয়। তারা হলেন, ফয়সাল, মোস্তাফিজ, গ্যাস বাবু ও সাইদুল করিম মিন্টু। এ ছাড়া ভারতে গ্রেপ্তার আছে সিয়াম ও কসাই জাহিদ।


কীভাবে হত্যার ছক এবং কার, কী দায় পেয়েছে গোয়েন্দারা: ডিবি ও কলকাতা সিআইডির তদন্ত সূত্রে জানা গেছে, এমপি আনারকে হত্যার পরিকল্পনা করে তারই বাল্যবন্ধু আক্তারুজ্জামান শাহীন। আর তা বাস্তবায়ন করে শিমুল ভূঁইয়া, তানভীর ভূঁইয়া, শিলাস্তি রহমান, জিহাদ হাওলাদারসহ অন্যরা। কলকাতার সঞ্জিভা গার্ডেনের ফ্ল্যাটে আনারকে হত্যার আগে গত জানুয়ারি ও মার্চ মাসে দুবার হত্যার পরিকল্পনা করে ব্যর্থ হয়। পরে ঠিক করা হয় কলকাতা নিয়ে গিয়ে হত্যা করা হবে আনারকে। সে অনুযায়ী, এমপি গতিবিধি নজরে রাখছিলেন শাহীনের লোকজন।


তৎকালীন তদন্ত ও তদারকি কর্মকর্তারা জানান, ব্যবসায়িক বৈঠকের কথা বলে আনারকে শাহীনই কলকাতায় ডেকে নেন। বৈঠকের স্থান নির্ধারণ করা হয় সঞ্জিভা গার্ডেনের ওই ফ্ল্যাটে। শাহীন ১১ মাসের জন্য এ ফ্ল্যাটটি ভাড়া করেন। এমপি আনার কলকাতায় পৌঁছার আগেই গত ৩০ এপ্রিল শিমুল ভূঁইয়া, শিলাস্তি রহমানকে নিয়ে ওই ফ্ল্যাটে ওঠেন শাহীন। হত্যার সব ছক চূড়ান্ত করে এমপি আনার কলকাতা পৌঁছার দুদিন আগে ১০ মে শাহীন দেশে ফিরে আসেন।


সঞ্জিভা গার্ডেনের ওই ফ্ল্যাটে এমপি আনার প্রবেশের পর তাকে দরজা খুলে গ্রহণ করেন শিলাস্তি রহমান। তদন্ত কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এক পর্যায়ে আনারকে ক্লোরোফর্ম দিয়ে অজ্ঞান করা হয়। এরপর বিবস্ত্র করে একটি চেয়ারে বেঁধে রাখে। এক পর্যায়ে হত্যা করা হয় তাকে।


গ্রেপ্তার আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদের বরাতে ঢাকার তদন্ত কর্মকর্তারা জানান, এমপি আনারকে হত্যার পর ওই ফ্ল্যাটের টয়লেটে নিয়ে তার হাড়-মাংস আলাদা করা হয়। মাংসের ছোট ছোট টুকরোর কিছু অংশ টয়লেটের কমোডে ফেলে দিয়ে ফ্লাশ করা হয়। হাড়সহ শরীরে অন্যান্য অংশ ট্রলিব্যাগে করে কলকাতার কৃষ্ণমাটি এলাকার জিরানগাছা বাগজোলা খালে ফেলে দেয় হত্যাকারীরা। আনারকে হত্যা ও মরদেহের হাড়-মাংস আলাদা করার কাজে আসামি ফয়সাল, মোস্তাফিজ ও জিহাদ সরাসরি জড়িত ছিল।


এমপি আনার হত্যার পর দুদেশের গোয়েন্দারাই নড়েচড়ে বসেন। ঘটনাস্থল পরিদর্শন, মরদেহের খণ্ডিতাংশ উদ্ধার ও আসামি গ্রেপ্তারে একাধিকবার কলকাতা ও নেপালে গেছেন ঢাকার তদন্ত কর্মকর্তারা। একইভাবে ঢাকায় গ্রেপ্তার আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য বাংলাদেশে আসেন কলকাতার তদন্ত কর্মকর্তারা।


এ হত্যাকাণ্ডের ঢাকায় হওয়া মামলাটির তদন্তের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এমন এক কর্মকর্তা বলেন, হত্যার সঙ্গে যারা সরাসরি জড়িত তাদের চিহ্নিত ও গ্রেপ্তার সম্ভব হয়েছে। এরপর কাজ ছিল সুবিধাভোগী এবং নেপথ্যের ক্রীড়নকদের খুঁজে বের করা। যেটা এখনো বের করা সম্ভব হয়নি। নতুন করে যারা তদন্ত করছে তারা নিশ্চয়ই সেগুলো সামনে নিয়ে আসবে।


এদিকে আনার হত্যার ঘটনায় মাস্টারমাইন্ড হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী আক্তারুজ্জামান শাহীনকে। তবে তিনি ঘটনার আগে কলকাতা থেকে ঢাকায় ফিরে আসেন। এরপর হত্যার খবরটি ছড়িয়ে পড়লে বাংলাদেশ থেকে দিল্লি, কাঠমান্ডু, দুবাই হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছান তিনি। শাহীন যুক্তরাষ্ট্রেই অবস্থান করছেন বলে জানা গেছে।


মূল পরিকল্পনাকারী শাহীনকে দেশে ফেরানোই বড় চ্যালেঞ্জ বলে জানিয়েছেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। তারা জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আসামি প্রত্যর্পণের কোনো চুক্তি না থাকায় বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে এ কাজটি সম্ভব হবে না। তবে ভারতের সঙ্গে প্রত্যর্পণ চুক্তি থাকায় ভারত সরকারের পক্ষে সম্ভব হবে। সেজন্য ভারতের পক্ষ থেকে ইন্টারপোলের কাছে সহযোগিতা চাওয়ার বিষয়টি জোর দেয়া হচ্ছে।


পুলিশ সদর দপ্তরে ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যুরো (এনসিবি) ইন্টারপোলের শাখা হিসেবে কাজ করে। বাংলাদেশ এনসিবির দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা জানিয়েছে, শাহীনকে গ্রেপ্তার ও দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র এনসিবির সহযোগিতা পাওয়া সুযোগ রয়েছে। আমরা সে লক্ষ্যে কাজ করছি।

 
Previous Post Next Post

Random Manga

Ads

نموذج الاتصال