দেশবাসীকে মুক্তি দিয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় প্রায় ২ সহস্রাধিক মানুষ নিহত হয়েছেন। ২০২৪-এর কোটা সংস্কার আন্দোলন হলো বাংলাদেশে সব ধরনের সরকারি চাকরিতে প্রচলিত কোটাভিত্তিক নিয়োগ ব্যবস্থার সংস্কারের দাবিতে সংগঠিত একটি আন্দোলন। সবারই জানা ১৬ বছরের কর্তৃত্ববাদী শাসনের কাছে দেশের ১৮ কোটি মানুষ জিম্মি হয়ে পড়েছিল। জনগণের কথা বলার অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। কর্তৃত্ববাদীদের ভ্রুকুটির সামনে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা হয়ে পড়েছিল রুদ্ধ। ব্যবসায়ীদের বাধ্য করা হয়েছে কর্তৃত্ববাদের হুকুম পালনে। কর্তৃত্ববাদের পতন শুধু কোটাবিরোধী বা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন নয় ১৭ কোটি মানুষের মহান জাতির বিজয় নিশ্চিত করেছে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন শুধু চাকরির ক্ষেত্রে অবাঞ্ছিত কোটা প্রথার বিরুদ্ধে নয়, এটি ছিল শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা থেকে দেশবাসীকে মুক্তি দেওয়ার আন্দোলন। দেড় দশক ধরে কর্তৃত্ববাদের থাবা দেশের সাংবিধানিক সব প্রতিষ্ঠানকে পঙ্গু করেছে। সেগুলো নতুনভাবে সাজাতে শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস সফল হবেন এমনটিই দেখতে চায় দেশবাসী।
জুলাই মাসে সংগঠিত বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন হলো বাংলাদেশের সাধারণ শিক্ষার্থীদের একটি যৌক্তিক আন্দোলন। কোটা সংস্কার আন্দোলন, পরবর্তীতে অসহযোগ আন্দোলনে রূপ লাভ করে। যার পরিপ্রেক্ষিতে শেখ হাসিনা পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়।
২০২৪ সালের ১ জুলাই কোটা সংস্কার আন্দোলন শুরু হয়। বাংলাদেশে কোটা সংস্কারের লক্ষ্যে ২০২৪ সালের ১ জুলাই থেকে চার দফা দাবিতে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’-এর ব্যানারে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা লাগাতার কর্মসূচি দেয়। ২ থেকে ৬ জুলাই দেশের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ, মানববন্ধন, মহাসড়ক অবরোধ ইত্যাদি কর্মসূচি পালন করে। ৭ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ঢাকায় গণপরিবহন বন্ধ এবং রাস্তা অবরোধ কর্মসূচি চালায় এবং পরবর্তীতে সারাদেশে অবরোধ কর্মসূচি দেওয়া হয় যা ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচি নামে পরিচিত। বাংলা ব্লকেড চলাকালীন রাজধানীতে শুধু মেট্রোরেল চালু ছিল। পরবর্তী দিনগুলিতেও ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে একই কর্মসূচি পালিত হয়। এইসব কর্মসূচিতে শিক্ষার্থীরা ছাত্রলীগ ও পুলিশি হামলার শিকার হয়। ১৪ জুলাই আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা ঢাকায় গণপদযাত্রা করে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন বরাবর স্মারকলিপি প্রদান করে। এদিন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার এক বক্তব্যে কোটা আন্দোলনকারীদের ‘রাজাকারের নাতি-পুতি’ হিসেবে অভিহিত করেন, তার মন্তব্যের প্রতিক্রিয়া হিসেবে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা ব্যঙ্গ করে ‘তুমি কে? আমি কে? রাজাকার, রাজাকার; কে বলেছে? কে বলেছে? স্বৈরাচার, স্বৈরাচার’ এবং ‘চাইতে গেলাম অধিকার; হয়ে গেলাম রাজাকার’ স্লোগান দেয়। এর পরেরদিন ১৫ জুলাই আওয়ামী লীগ ও তৎকালীন সরকারের বিভিন্ন কর্মকর্তা, মন্ত্রী আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ নষ্ট করার অভিযোগ আনে। ১৫ জুলাই বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘গত রাতে বিক্ষোভ করে আমরা সোমবার ১২টায় প্রধানমন্ত্রীকে তার বক্তব্য প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছিলাম। প্রত্যাহার না হওয়ায় আমরা রাস্তায় নেমেছি’। পরবর্তী দিনগুলোয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে দেশের বিভিন্ন স্থানে আন্দোলন চলে। ১৭ জুলাই রাতে তারা ১৮ জুলাইয়ের জন্য ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচির ঘোষণা করে।
১৯ জুলাইতেও সারাদেশে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকা সর্বাত্মক অবরোধ চলে। এদিন মধ্যরাতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক নাহিদ ইসলামকে আটক করা হয়। যে সময়ে নাহিদ ইসলামকে আটক করা তার কাছাকাছি সময়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের তিনজন প্রতিনিধির সাথে সরকারের তিনজন প্রতিনিধির একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় যেখানে তারা সরকারের কাছে ‘আট দফা দাবি’ জানান। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষে আলোচনায় অংশ নেন সমন্বয়ক সারজিস আলম ও হাসনাত আব্দুল্লাহ এবং সহ-সমন্বয়ক তানভীর আহমেদ।
২১ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একটি পক্ষ ‘৯ দফা’ দাবি জানিয়ে শাটডাউন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেয়। ২২ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম চার দফা দাবি জানিয়ে ৪৮ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দিয়ে ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি স্থগিত করেন, তিনি জানান ‘আমাদের চার দফার মধ্যে রয়েছে - ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ইন্টারনেট চালু, ক্যাম্পাসগুলো থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী প্রত্যাহার করে ক্যাম্পাস চালু, সমন্বয়ক ও আন্দোলনকারীদের নিরাপত্তা প্রদান এবং কারফিউ প্রত্যাহার... যারা নয় দফা দাবি ও শাটডাউন অব্যাহত রেখেছে তাদের সাথে আমাদের নীতিগত কোনো বিরোধ নেই। নিজেদের মধ্যে কোনো যোগাযোগ না থাকায় আমরা তাদের সাথে কথা বলতে পারছি না’। ১৯ জুলাই থেকে নিখোঁজ থাকার পর ২৪ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ, আবু বাকের মজুমদার ও রিফাত রশীদের খোঁজ পাওয়া যায়। ২৫ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে আটটি বার্তা দেওয়া হয়। এর মধ্যে রয়েছে হতাহতদের তালিকা তৈরি, হত্যা ও হামলায় জড়িতদের চিহ্নিত করা, বিশ্ববিদ্যালয় ও হল খুলে দেওয়ার চাপ তৈরি করা।
২৬ জুলাই নাহিদ ইসলামসহ কোটা সংস্কার আন্দোলনের তিন সমন্বয়ককে রাজধানীর গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতাল থেকে তুলে নিয়ে যায় সাদা পোশাকের এক দল ব্যক্তি। তারা নিজেদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য পরিচয় দিয়েছেন বলে সেখানে উপস্থিত এক সমন্বয়কের স্বজন ও হাসপাতালের চিকিৎসকেরা জানান। ২৭ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন সংগঠনের আরও দুই সমন্বয়ককে হেফাজতে নেয় গোয়েন্দা শাখা। তারা হলেন সারজিস আলম ও হাসনাত আবদুল্লাহ। পরে এক অনলাইন সংবাদ সম্মেলনে ২৮ তারিখের (রোববারের) মধ্যে সমন্বয়ক নাহিদ ইসলামসহ, আসিফ মাহমুদসহ আটক সব শিক্ষার্থীদের মুক্তি, মামলা প্রত্যাহার ও শিক্ষার্থী গণহত্যার সাথে জড়িত মন্ত্রী পর্যায় থেকে কনস্টেবল পর্যন্ত সব দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আল্টিমেটাম দেয় আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। একই সাথে রোববার সারা দেশের দেয়ালগুলোয় গ্রাফিতি ও দেয়াল লিখনসহ বিভিন্ন কর্মসূচির ঘোষণা দেওয়া হয়। ২৮ জুলাই রাত ১০টার দিকে পুলিশি হেফাজতে থাকা ৬ সমন্বয়ক আন্দোলন প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন। কিন্তু পুলিশে আটক হওয়া অবস্থায় পুলিশের অফিসে বসেই বাকি সমন্বয়কারীদের সাথে যোগাযোগ না করে এমন ঘোষণা দেওয়ায় এই ঘোষণাকে সরকার ও পুলিশের চাপে দেওয়া হয়েছে বলে আখ্যায়িত করে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেয় বাকিরা।
জাতীয়
দেশবাসীকে মুক্তি দিয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন
দয়াল কুমার বড়ুয়া
১৩ জানুয়ারি ২০২৫, ১৪:৫৫
দেশবাসীকে মুক্তি দিয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় প্রায় ২ সহস্রাধিক মানুষ নিহত হয়েছেন। ২০২৪-এর কোটা সংস্কার আন্দোলন হলো বাংলাদেশে সব ধরনের সরকারি চাকরিতে প্রচলিত কোটাভিত্তিক নিয়োগ ব্যবস্থার সংস্কারের দাবিতে সংগঠিত একটি আন্দোলন। সবারই জানা ১৬ বছরের কর্তৃত্ববাদী শাসনের কাছে দেশের ১৮ কোটি মানুষ জিম্মি হয়ে পড়েছিল। জনগণের কথা বলার অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। কর্তৃত্ববাদীদের ভ্রুকুটির সামনে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা হয়ে পড়েছিল রুদ্ধ। ব্যবসায়ীদের বাধ্য করা হয়েছে কর্তৃত্ববাদের হুকুম পালনে। কর্তৃত্ববাদের পতন শুধু কোটাবিরোধী বা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন নয় ১৭ কোটি মানুষের মহান জাতির বিজয় নিশ্চিত করেছে।
বিজ্ঞাপন
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন শুধু চাকরির ক্ষেত্রে অবাঞ্ছিত কোটা প্রথার বিরুদ্ধে নয়, এটি ছিল শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা থেকে দেশবাসীকে মুক্তি দেওয়ার আন্দোলন। দেড় দশক ধরে কর্তৃত্ববাদের থাবা দেশের সাংবিধানিক সব প্রতিষ্ঠানকে পঙ্গু করেছে। সেগুলো নতুনভাবে সাজাতে শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস সফল হবেন এমনটিই দেখতে চায় দেশবাসী।
জুলাই মাসে সংগঠিত বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন হলো বাংলাদেশের সাধারণ শিক্ষার্থীদের একটি যৌক্তিক আন্দোলন। কোটা সংস্কার আন্দোলন, পরবর্তীতে অসহযোগ আন্দোলনে রূপ লাভ করে। যার পরিপ্রেক্ষিতে শেখ হাসিনা পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়।
বিজ্ঞাপন
২০২৪ সালের ১ জুলাই কোটা সংস্কার আন্দোলন শুরু হয়। বাংলাদেশে কোটা সংস্কারের লক্ষ্যে ২০২৪ সালের ১ জুলাই থেকে চার দফা দাবিতে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’-এর ব্যানারে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা লাগাতার কর্মসূচি দেয়। ২ থেকে ৬ জুলাই দেশের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ, মানববন্ধন, মহাসড়ক অবরোধ ইত্যাদি কর্মসূচি পালন করে। ৭ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ঢাকায় গণপরিবহন বন্ধ এবং রাস্তা অবরোধ কর্মসূচি চালায় এবং পরবর্তীতে সারাদেশে অবরোধ কর্মসূচি দেওয়া হয় যা ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচি নামে পরিচিত। বাংলা ব্লকেড চলাকালীন রাজধানীতে শুধু মেট্রোরেল চালু ছিল। পরবর্তী দিনগুলিতেও ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে একই কর্মসূচি পালিত হয়। এইসব কর্মসূচিতে শিক্ষার্থীরা ছাত্রলীগ ও পুলিশি হামলার শিকার হয়। ১৪ জুলাই আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা ঢাকায় গণপদযাত্রা করে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন বরাবর স্মারকলিপি প্রদান করে। এদিন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার এক বক্তব্যে কোটা আন্দোলনকারীদের ‘রাজাকারের নাতি-পুতি’ হিসেবে অভিহিত করেন, তার মন্তব্যের প্রতিক্রিয়া হিসেবে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা ব্যঙ্গ করে ‘তুমি কে? আমি কে? রাজাকার, রাজাকার; কে বলেছে? কে বলেছে? স্বৈরাচার, স্বৈরাচার’ এবং ‘চাইতে গেলাম অধিকার; হয়ে গেলাম রাজাকার’ স্লোগান দেয়। এর পরেরদিন ১৫ জুলাই আওয়ামী লীগ ও তৎকালীন সরকারের বিভিন্ন কর্মকর্তা, মন্ত্রী আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ নষ্ট করার অভিযোগ আনে। ১৫ জুলাই বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘গত রাতে বিক্ষোভ করে আমরা সোমবার ১২টায় প্রধানমন্ত্রীকে তার বক্তব্য প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছিলাম। প্রত্যাহার না হওয়ায় আমরা রাস্তায় নেমেছি’। পরবর্তী দিনগুলোয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে দেশের বিভিন্ন স্থানে আন্দোলন চলে। ১৭ জুলাই রাতে তারা ১৮ জুলাইয়ের জন্য ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচির ঘোষণা করে।
১৯ জুলাইতেও সারাদেশে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকা সর্বাত্মক অবরোধ চলে। এদিন মধ্যরাতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক নাহিদ ইসলামকে আটক করা হয়। যে সময়ে নাহিদ ইসলামকে আটক করা তার কাছাকাছি সময়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের তিনজন প্রতিনিধির সাথে সরকারের তিনজন প্রতিনিধির একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় যেখানে তারা সরকারের কাছে ‘আট দফা দাবি’ জানান। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষে আলোচনায় অংশ নেন সমন্বয়ক সারজিস আলম ও হাসনাত আব্দুল্লাহ এবং সহ-সমন্বয়ক তানভীর আহমেদ।
বিজ্ঞাপন
২১ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একটি পক্ষ ‘৯ দফা’ দাবি জানিয়ে শাটডাউন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেয়। ২২ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম চার দফা দাবি জানিয়ে ৪৮ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দিয়ে ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি স্থগিত করেন, তিনি জানান ‘আমাদের চার দফার মধ্যে রয়েছে - ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ইন্টারনেট চালু, ক্যাম্পাসগুলো থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী প্রত্যাহার করে ক্যাম্পাস চালু, সমন্বয়ক ও আন্দোলনকারীদের নিরাপত্তা প্রদান এবং কারফিউ প্রত্যাহার... যারা নয় দফা দাবি ও শাটডাউন অব্যাহত রেখেছে তাদের সাথে আমাদের নীতিগত কোনো বিরোধ নেই। নিজেদের মধ্যে কোনো যোগাযোগ না থাকায় আমরা তাদের সাথে কথা বলতে পারছি না’। ১৯ জুলাই থেকে নিখোঁজ থাকার পর ২৪ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ, আবু বাকের মজুমদার ও রিফাত রশীদের খোঁজ পাওয়া যায়। ২৫ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে আটটি বার্তা দেওয়া হয়। এর মধ্যে রয়েছে হতাহতদের তালিকা তৈরি, হত্যা ও হামলায় জড়িতদের চিহ্নিত করা, বিশ্ববিদ্যালয় ও হল খুলে দেওয়ার চাপ তৈরি করা।
২৬ জুলাই নাহিদ ইসলামসহ কোটা সংস্কার আন্দোলনের তিন সমন্বয়ককে রাজধানীর গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতাল থেকে তুলে নিয়ে যায় সাদা পোশাকের এক দল ব্যক্তি। তারা নিজেদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য পরিচয় দিয়েছেন বলে সেখানে উপস্থিত এক সমন্বয়কের স্বজন ও হাসপাতালের চিকিৎসকেরা জানান। ২৭ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন সংগঠনের আরও দুই সমন্বয়ককে হেফাজতে নেয় গোয়েন্দা শাখা। তারা হলেন সারজিস আলম ও হাসনাত আবদুল্লাহ। পরে এক অনলাইন সংবাদ সম্মেলনে ২৮ তারিখের (রোববারের) মধ্যে সমন্বয়ক নাহিদ ইসলামসহ, আসিফ মাহমুদসহ আটক সব শিক্ষার্থীদের মুক্তি, মামলা প্রত্যাহার ও শিক্ষার্থী গণহত্যার সাথে জড়িত মন্ত্রী পর্যায় থেকে কনস্টেবল পর্যন্ত সব দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আল্টিমেটাম দেয় আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। একই সাথে রোববার সারা দেশের দেয়ালগুলোয় গ্রাফিতি ও দেয়াল লিখনসহ বিভিন্ন কর্মসূচির ঘোষণা দেওয়া হয়। ২৮ জুলাই রাত ১০টার দিকে পুলিশি হেফাজতে থাকা ৬ সমন্বয়ক আন্দোলন প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন। কিন্তু পুলিশে আটক হওয়া অবস্থায় পুলিশের অফিসে বসেই বাকি সমন্বয়কারীদের সাথে যোগাযোগ না করে এমন ঘোষণা দেওয়ায় এই ঘোষণাকে সরকার ও পুলিশের চাপে দেওয়া হয়েছে বলে আখ্যায়িত করে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেয় বাকিরা।
আরও পড়ুন
গ্রামীণ অর্থনীতির সংকট ও উত্তরণ
প্রাণীর মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া রোগ ও প্রতিকার
গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও নির্বাচনের অভিযাত্রায় সেনাবাহিনী
৩১ জুলাই হত্যা, গণগ্রেপ্তার, হামলা, মামলা ও গুমের প্রতিবাদে ৩১ জুলাই বুধবার সারাদেশে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ (ন্যায়বিচারের জন্য পদযাত্রা) কর্মসূচি পালন করে। ১ আগস্ট গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) হেফাজতে থাকা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ছয় সমন্বয়ককে বেলা দেড়টার একটু পরেই ছেড়ে দেওয়া হয়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ২ আগস্ট শুক্রবার ‘প্রার্থনা ও ছাত্র-জনতার গণমিছিল’ কর্মসূচি ঘোষণা করে। ২ আগস্ট গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) হেফাজত থেকে ছাড়া পাওয়া বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ছয় সমন্বয়ক গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে বলেন যে আন্দোলন প্রত্যাহার করে ডিবি অফিস থেকে প্রচারিত ছয় সমন্বয়কের ভিডিও বিবৃতিটি তারা স্বেচ্ছায় দেননি।
৩ আগস্ট অনির্দিষ্টকালের জন্য সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেওয়া হয়। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে দেওয়া হয় অসহযোগ আন্দোলনের রূপরেখা। রূপরেখাগুলো ছিল—
১। কেউ কোনো ধরনের ট্যাক্স বা খাজনা প্রদান করবেন না।
২। বিদ্যুৎ বিল, গ্যাস বিল, পানির বিলসহ কোনো ধরনের বিল পরিশোধ করবেন না।
৩। সব ধরনের সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, অফিস আদালত ও কল কারখানা বন্ধ থাকবে। আপনারা কেউ অফিসে যাবেন না, মাস শেষে বেতন তুলবেন।
৪। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের কার্যক্রম বন্ধ থাকবে।
৫। প্রবাসীরা ব্যাংকিং চ্যানেলে কোনো ধরনের রেমিট্যান্স দেশে পাঠাবেন না।
৬। সব ধরনের সরকারি সভা, সেমিনার, আয়োজন বর্জন করবেন।
৭। বন্দরের কর্মীরা কাজে যোগ দেবেন না। কোনো ধরনের পণ্য খালাস করবেন না।
৮। দেশের কোনো কলকারখানা চলবে না, গার্মেন্টসকর্মী কাজে যাবেন না।
৯। গণপরিবহন বন্ধ থাকবে। শ্রমিকরা কেউ কাজে যাবেন না।
১০। জরুরি ব্যক্তিগত লেনদেনের জন্য প্রতি সপ্তাহের রোববার ব্যাংকগুলো খোলা থাকবে।
১১। পুলিশ সদস্যরা রুটিন ডিউটি ব্যতীত কোনো ধরনের প্রটোকল ডিউটি, রায়ট ডিউটি ও প্রটেস্ট ডিউটিতে যাবেন না। শুধু থানা পুলিশ নিয়মিত থানার রুটিন ওয়ার্ক করবে।
১২। দেশ থেকে যেন একটি টাকাও পাচার না হয়, সব অফশোর ট্রানজেকশন বন্ধ থাকবে।
১৩। বিজিবি ও নৌবাহিনী ব্যতীত অন্যান্য বাহিনী সেনানিবাসের বাইরে ডিউটি পালন করবে না। বিজিবি ও নৌবাহিনী ব্যারাক ও কোস্টাল এলাকায় থাকবে।
১৪। আমলারা সচিবালয়ে যাবেন না, ডিসি বা উপজেলা কর্মকর্তারা নিজ নিজ কার্যালয়ে যাবেন না।
১৫। বিলাস দ্রব্যের দোকান, শো রুম, বিপণিবিতান, হোটেল, মোটেল, রেস্টুরেন্ট বন্ধ থাকবে। তবে হাসপাতাল, ফার্মেসি, ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জাম পরিবহন, অ্যাম্বুলেন্স সেবা, ফায়ার সার্ভিস, গণমাধ্যম, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য পরিবহন, জরুরি ইন্টারনেট সেবা, জরুরি ত্রাণ সহায়তা এবং এই খাতে কর্তব্যরত কর্মকর্তা-কর্মচারী পরিবহন সেবা চালু থাকবে। নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের দোকান বেলা ১১টা থেকে ১টা পর্যন্ত খোলা থাকবে।
এক দফা দাবি—
৩ আগস্ট শহীদ মিনার থেকে সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম সরকার পদত্যাগের এক দফা আন্দোলন ঘোষণা করেন। এক দফা ঘোষণার সময় শহীদ মিনারে আরও উপস্থিত ছিলেন অন্যান্য সমন্বয়করা। তারা হলেন নাহিদ ইসলাম, সারজিস আলম, হাসনাত আবদুল্লাহ, আসিফ মাহমুদ, আবু বাকের মজুমদার ও আবদুল কাদের।
শুরুতে ৬ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন ‘লং মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি ঘোষণা করে। তবে এই পরিস্থিতি বিবেচনায় সমন্বয়করা কর্মসূচি একদিন এগিয়ে এনে ৫ আগস্ট ঘোষণা করেন। আন্দোলনকে ঘিরে ৫ আগস্ট অনেক জেলায় পাল্টাপাল্টি ধাওয়া, সংঘর্ষ এবং গোলাগুলির ঘটনা ঘটে, এতে ১০৮জন সাধারণ নাগরিক ও পুলিশ নিহত হয়।
৫ আগস্ট শেখ হাসিনা এক দফা দাবির প্রেক্ষিতে সম্মিলিত ছাত্র-জনতার এক গণঅভ্যুত্থানে পদত্যাগ করেন এবং দেশ থেকে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেন। এরই মধ্য দিয়ে তার ১৫ বছরেরও বেশি সময়ের শাসনের অবসান ঘটে।
দয়াল কুমার বড়ুয়া ।। কলামিস্ট ও চবি অ্যালামনাই বসুন্ধরার সভাপতি। সাবেক ট্রাস্টি, বৌদ্ধ ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্ট
Tags
জাতীয়