মধ্যবিত্তের সংজ্ঞায়ন ও চিহ্নিতকরণে গোটা বিশ্বে সর্বজনগ্রাহ্য সংজ্ঞা নেই। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। আবার বিশ্বের বিভিন্ন দেশ যেমন নিজেদের জনসমাজকে বিশ্লেষণ করে একটি নিজস্ব সংজ্ঞায়ন করে নিয়েছে, তেমনটি বাংলাদেশ করেনি। ফলে বড় ধরনের তথ্যঘাটতি রয়েছে।
এই তথ্যঘাটতি নিয়ে প্রথম পর্বেই সবিস্তারে আলোচনা হয়েছে। তবুও কিছু তথ্যে চোখ বোলানো যাক। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) তৎকালীন গবেষণা পরিচালক ড. বিনায়ক সেন ২০১৫ সালে এ দেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণির ওপর একটি গবেষণা করেছিলেন। ‘সাইজ অ্যান্ড গ্রোথ অব দ্য মিডল ক্লাস ইন বাংলাদেশ: ট্রেন্ডস, প্রোফাইলস অ্যান্ড ড্রাইভারস’ শিরোনামের সেই গবেষণায় দেখা যায়, বাংলাদেশের ওই সময়কার মোট জনসংখ্যার ২০ শতাংশ জনগোষ্ঠী বা ৩ কোটি ৫০ লাখের বেশি মানুষ ছিল মধ্যবিত্ত।
এ সম্পর্কিত আরও কিছু গবেষণা (প্রথম পর্ব দ্রষ্টব্য) ও দেশের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত সাম্প্রতিক প্রতিবেদন ও নিবন্ধ বা কলাম ঘেঁটেও দেখা গেছে যে, প্রায় প্রতিটিতেই বাংলাদেশের মধ্যবিত্তের আকার কম‑বেশি সাড়ে ৩ কোটি থেকে ৪ কোটি পর্যন্ত ধরা হয়েছে। বিভিন্ন খাতের বিশেষজ্ঞরাও তেমনটাই বলছেন। যদিও কাকে মধ্যবিত্ত বলা হবে, আর কাকে বলা হবে না, এ নিয়ে দেশের গবেষকদের মধ্যেই ব্যাপক মতদ্বৈধতা আছে।
ছবি: পেক্সেলএখন, এই প্রশ্নের মোক্ষম উত্তর দিতে পারত বিস্তৃত আকারে করা একটি জাতীয় পর্যায়ের গবেষণা ও জরিপ। কিন্তু সেসবেরই যে বড্ড অভাব! এমনকি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ও সংস্থাগুলোও এ অভিযোগ করেছে। ২০১৬ সালের মার্চে ‘Emerging Middle Income Class in Bangladesh’ শীর্ষক একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছিল উন্নয়ন সংস্থা জাইকা বাংলাদেশ। তাতে বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত সম্পর্কিত ‘বাস্তবানুগ পরিসংখ্যানের যথেষ্ট অপ্রাপ্যতা রয়েছে’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
একই ধরনের মন্তব্য সম্প্রতি করেছে ব্রিটিশ সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্ট’ও। তারাও বলেছে, বাংলাদেশে এ‑সংক্রান্ত পরিসংখ্যানের অভাব প্রকট এবং তাদের ভাষায়, ‘অপ্রাপ্য’ বা ‘দুষ্প্রাপ্য’।
অর্থাৎ, বিদেশি সংস্থাগুলোও বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণি বিষয়ক বিশদ তথ্য ও পরিসংখ্যানের অভাবের বিষয়টি স্পষ্ট করেই বলছে। তবে এ নিয়ে আমাদের দেশের বিভিন্ন সময় ক্ষমতায় থাকা নানা সরকার বা এ সংক্রান্ত সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মাথাব্যথা খুব একটা নেই। তবে এই অসংজ্ঞায়িত মধ্যবিত্তের ঘাড়ে অন্যায্য জোয়াল তুলে দেওয়ার রেওয়াজটা ঠিকই আছে।
বাংলাদেশে এখন কেমন আছে মধ্যবিত্তরা?
এ বিষয়ে আগে সরকারের নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়ে জেনে নেওয়া যাক।
বাংলাদেশে ভ্যাট বসে শ্রেণি নির্বিশেষে। গরিব‑বড়লোক কোনো ভেদাভেদ নেই। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশে শাসনক্ষমতায় থাকা সব সরকারই আদতে একই প্রকৃতির। সর্বশেষ গত ৯ জানুয়ারি শতাধিক পণ্য ও সেবায় ভ্যাট ও শুল্ক বাড়িয়ে অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছিল। ওই সময় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) রেস্তোরাঁয় ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে ১৫ শতাংশ করার পরিকল্পনা নিয়েছিল। নন-এসি হোটেলের ভ্যাট ৭.৫ শতাংশ থেকে দ্বিগুণ করে ১৫ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তে পারে বলে এনবিআর সূত্র জানিয়েছিল। পোশাক খাতে ব্র্যান্ডেড ও নন-ব্র্যান্ডেড উভয় ধরনের পণ্যের ওপর ভ্যাট ৭.৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করার প্রস্তাব ছিল। পাশাপাশি ট্রেডিং কার্যক্রমে ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে ৭.৫ শতাংশ এবং এলপিজির ট্রেডিং পর্যায়ে ভ্যাটও ৫ শতাংশ থেকে ৭.৫ শতাংশে উন্নীত করার কথা ছিল।
ছবি: পেক্সেলপরে অবশ্য সংশ্লিষ্ট খাতের ব্যবসায়ীদের প্রবল সমালোচনা ও ক্ষোভের মুখে গত ২২ জানুয়ারি, মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট বাড়ানোর দুই সপ্তাহের মধ্যে ১০টি পণ্য ও সেবায় ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক কমায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এ তালিকায় আছে মোবাইল ফোন সেবা, রেস্তোরাঁ, ওষুধ, নিজস্ব ব্র্যান্ডের পোশাক, মিষ্টি, নন-এসি হোটেল, ওয়ার্কশপ ইত্যাদি। তবে তাই বলে সব পণ্য বা সেবায় কিন্তু কমানো হয়নি। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, নন-এসি হোটেলের ওপর ভ্যাট হার ১৫ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ করা হয়েছে। তবে ৯ জানুয়ারির আগে এ হার ছিল সাড়ে ৭ শতাংশ। অর্থাৎ নন-এসি হোটেলে ভ্যাট আড়াই শতাংশ বেড়েছে। আবার নিজস্ব ব্র্যান্ডের পোশাক ব্যতীত অন্যান্য পোশাক বিক্রির ক্ষেত্রে ভ্যাট হার আগের মতোই সাড়ে ৭ শতাংশে নামানো হয়েছে। যা বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছিল। তবে নিজস্ব ব্র্যান্ডের পোশাকের ক্ষেত্রে বাড়তি ভ্যাট দিতে হবে। এসব পোশাকে আগে ভ্যাট হার ছিল সাড়ে ৭ শতাংশ। ৯ জানুয়ারি দ্বিগুণ বাড়িয়ে করা হয় ১৫ শতাংশ। এখন ৫ শতাংশ কমিয়ে নির্ধারণ করা হয় ১০ শতাংশ। অর্থাৎ এ ধরনের পোশাকে ভ্যাট আড়াই শতাংশ বেড়েছে। একইভাবে মিষ্টির ওপর ভ্যাট হার সাড়ে ৭ শতাংশ থেকে দ্বিগুণ বাড়িয়ে করা হয়েছিল ১৫ শতাংশ। এখন ৫ শতাংশ কমিয়ে নির্ধারণ করা হয়েছে ১০ শতাংশ। সেই হিসাবে মিষ্টিতেও ভ্যাট বেড়েছে।
এভাবে বাড়িয়ে‑কমিয়ে আদতে বাড়ানোই হয়েছে বেশ কিছু ক্ষেত্রে। আবার অনেক ক্ষেত্রে তো বাড়ানোই আছে। এমন প্রক্রিয়ায় ধনী ব্যতীত অন্য সব শ্রেণির মানুষকে এক অসহনীয় আর্থিক চাপে ফেলে দেওয়া হয়েছে। মধ্যবিত্ত পড়েছে শাঁখের করাতে। অথচ এমন সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সরকার সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর সাথে একবারের জন্যও আলোচনা করার প্রয়োজন বোধ করেনি। ব্যবসায়ীদেরকেই এ ক্ষেত্রে উপেক্ষা করা হয়েছে বলে জানা গেছে। সেক্ষেত্রে ভোক্তাদের বা যারা এই বর্ধিত ভ্যাট আসলে দেবে, তাদেরকে তো গোণায়ই ধরা হয়নি! এ যেন একবিংশ শতাব্দীর এক নব্য জমিদারি ব্যবস্থা, যেখানে নাগরিকেরা কেবলই প্রজা হিসেবে গণ্য হন।
প্রতীকী ছবিওপরের এই প্রক্রিয়ার আরও একটি দিক তুলে ধরা যাক। দেখাই যাচ্ছে যে, ৯ জানুয়ারি এক ধরনের ভ্যাট আরোপ ও আদায় করার কাজ শুরু হয়েছিল। পরে ২২ জানুয়ারি আবার কিছু পণ্য ও সেবায় ভ্যাট কমানোর কথাও বলা হলো। এখন, এই মাঝের ১০/১২ দিন কিন্তু বর্ধিত হারেই ভ্যাট আদায় হয়েছে। তাহলে সরকারের এই সিদ্ধান্তবিষয়ক দোনোমনার মূল্য চোকাতে হলো সেই সাধারণ মানুষকেই। কিন্তু কেন? এ দেশের জনসাধারণের টাকার কি কোনো মূল্য নেই? বেশি সস্তা? নাকি জনসাধারণ কেবলই সরকার বাহাদুরের কাছে কেবলই অর্থ কামানোর মেশিন?
এমনিতেই করোনা মহামারির অভিঘাত এবং ইউক্রেন‑সিরিয়া‑ফিলিস্তিন সংক্রান্ত ভূরাজনৈতিক সংকটে ভুগতে হচ্ছে এ দেশের মধ্য থেকে নিম্নবিত্তকে। তারই মধ্যে চাপিয়ে দেওয়া হলো বাড়তি করের বোঝা। অন্যদিকে বাজারে মূলস্ফীতি ছুটছে পাগলা ঘোড়ার মতো। সংবাদমাধ্যমের সাম্প্রতিক খবরে প্রকাশ, গত তিন বছর দেশে প্রতি মাসে মূল্যস্ফীতির তুলনায় পিছিয়েছে মজুরি বৃদ্ধির হার। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য বলছে, ২০২২ সালের জানুয়ারির পর থেকে ২০২৪‑এর ডিসেম্বর পর্যন্ত কোনো মাসেই মজুরি মূল্যস্ফীতিকে পেছনে ফেলতে পারেনি। সদ্য বিদায়ী মাসেও খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ১২ দশমিক ৯২ ভাগ। মজুরি বৃদ্ধির হার ছিল মাত্র ৮ দশমিক ১৪ ভাগ। এতে করে প্রকৃত আয় কমায় জীবনধারণে হিমশিম খাচ্ছে সাধারণ মানুষ। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বিদায়ী সরকারের পথে হাঁটায় মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়েছে বর্তমান সরকারও। ফলে মূল্যস্ফীতির প্রভাবে মধ্যবিত্তেরই এ দেশে নাকাল অবস্থা এখন। তাহলে, নিম্ন আয়ের মানুষের কষ্ট কোন মাত্রার? নিজের দিকে তাকিয়ে মাপলেই আমরা যে কেউ বুঝে যাব।
এবার সরকারের মধ্যবিত্ত শ্রেণির প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি কেমন ধারার, সেটি আরেকটু বিশদে বুঝে নেওয়া যাক।
২০১৫ সালে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) তৎকালীন গবেষণা পরিচালক ড. বিনায়ক সেন এ দেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণির ওপর যে গবেষণা করেছিলেন, তাতে বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণির চরিত্রটি কেমন–তাও কিছুটা উঠে এসেছিল। ‘সাইজ অ্যান্ড গ্রোথ অব দ্য মিডল ক্লাস ইন বাংলাদেশ: ট্রেন্ডস, প্রোফাইলস অ্যান্ড ড্রাইভারস’ শীর্ষক ওই গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে যত মধ্যবিত্ত রয়েছে, এর ৪৮ দশমিক ৪ শতাংশ বা প্রায় অর্ধেকই বেসরকারি চাকরি করে। আর ২০ শতাংশের বেশি সরকারি চাকরি করে। মধ্যবিত্তদের মাত্র প্রায় ২২ শতাংশ ব্যবসা করে। নিম্নমধ্যবিত্তের মধ্যে ৫১ দশমিক ৬ শতাংশ বেসরকারি চাকরি করে। আর ব্যবসায় সম্পৃক্ত মাত্র ১৭ শতাংশ।
অর্থাৎ, মধ্যবিত্ত শ্রেণি মূলত বেসরকারি চাকরি ও ব্যবসার ওপর নির্ভরশীল। এই ব্যবসা অবশ্যই বৃহৎ শিল্প-কারখানা তৈরি করে হয় না। পুঁজির অভাবের কারণেই এ দেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণি মূলত খুচরা পর্যায়ের ব্যবসা করে থাকে। এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ভ্যাটের বোঝা চাপিয়ে তাতে এমনিতেই বাদ সেধে রেখেছে সরকারি নিয়মকানুন। আবার হাজার হাজার কোটি টাকার ব্যাংকঋণ এ দেশে প্রায় ফ্রিতে মিললেও, কয়েক লাখ টাকার ব্যাংকঋণ পেতে গলদঘর্ম হতে হয়ই। আর যে মধ্যবিত্ত শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত প্রায় অর্ধেক মানুষ বেসরকারি চাকরি করে, সেই খাতে তো বৈষম্যের শেষ নেই। সরকারি চাকরির সঙ্গে বেসরকারি চাকরির বৈষম্য আবার তৈরি করছে সরকার নিজেই!
ছবি: পেক্সেলএ দেশের বেসরকারি চাকরিজীবীরা বৈষম্যের চাপে একেবারে কোণঠাসা হয়েই যেন পড়েছেন। কোণঠাসা হয়ে পড়া মানে, তার থেকে মুক্তি পাওয়া যেমন কঠিন, তেমনি তাতে আটকে থাকাও ততধিক অসহ্য! এমন এক অবস্থাতেই আছে এ দেশের বেসরকারি চাকরিজীবীরা। তারা প্রতিনিয়ত মাথার ঘাম পায়ে বা মাটির নিচ পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে আয় করছে। সেখান থেকে নানাভাবে সরকারকে কর দিচ্ছে। তাদের অনেকের মাথায় ঘামের পাশাপাশি এই চিন্তাটা হয়তো থাকে যে, খরচ যা-ই হোক চাকরি শেষে প্রভিডেন্ট ফান্ড থেকে কিছু টাকা নিশ্চয়ই পাব। সেই চিন্তা অবশ্য এখন ধীরে ধীরে দুশ্চিন্তায় পরিণত হতে পারে। কারণ, তাদের ওই শেষ সম্বল প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা থেকেও যে বেশি বেশি কর দিতে হচ্ছে। আয়কর আইন ২০২৩-এ প্রভিডেন্ট ফান্ডের ওপর কর আরোপের নতুন বিধান অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তাতে বলা হয়, আইন অনুযায়ী ওই অর্থবছর থেকেই বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রভিডেন্ট ফান্ড থেকে অর্জিত আয়ের ওপর কর রিটার্ন দাখিল করতে হবে। একই সঙ্গে প্রভিডেন্ট ফান্ডের অর্থ কোথাও বিনিয়োগ করা হলে ওই আয়ের ওপর ২৭ দশমিক ৫ শতাংশ হারে কর দিতে হবে। এর জেরে বেসরকারি কর্মীদের অবসরকালীন সুবিধা কমে যাওয়ার আশঙ্কা প্রবলভাবে আলোচ্য হয়ে ওঠে। একপর্যায়ে সমালোচনার মুখে বেসরকারি চাকরিজীবীদের প্রভিডেন্ট ফান্ডের আয়ের ওপর আরোপিত করহার সাড়ে ২৭ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়।
কিন্তু আদতে বেসরকারি চাকরিজীবীদের সেই বেশি কর দেওয়ার মেশিন বানিয়েই রাখা হয়। তাঁদের বৈষম্যের জাঁতাকলেই পেষার ব্যবস্থা জারি থাকে। কারণ, আগে সরকারি বা বেসরকারি কোনো খাতের চাকরিজীবীদের ভবিষ্য তহবিল (প্রভিডেন্ট ফান্ড) থেকেই কর কাটা হতো না। প্রভিডেন্ট ফান্ড ও গ্র্যাচুইটি ফান্ড–এই দুটিকেই আয়কর দিতে হতো না। ২০১৬ সাল পর্যন্ত চলে এই নিয়ম। এর পর থেকে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগের মুনাফার ওপর উৎসে কর হিসেবে ৫ থেকে ১০ শতাংশ কর কেটে রাখা হতো। অথচ সরকারি খাত করমুক্তই থেকে যায়। আর আয়কর আইন ২০২৩-এ প্রভিডেন্ট ফান্ডের ওপর কর আরোপের নতুন বিধান অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তবে আগের মতোই সরকারি চাকরিজীবীরা থেকে যায় ধরা-ছোঁয়ার বাইরেই।
এর বাইরে আরও আছে চাকরির নিরাপত্তাজনিত উৎকন্ঠা। সরকারি চাকরি স্থায়িত্ব সম্পর্কিত যে নিশ্চয়তা দেয়, বেসরকারি চাকরি তা দেয় না। বেসরকারি খাতের জন্য একটা শ্রম আইন করে দিয়েই সরকার হাত ধুয়ে ফেলেছে বলা চলে। সেটি ঠিকমতো মানা হয় কিনা, না মানলে প্রতিকার মেলে কিনা–এসবে সরকারের মনোযোগ খুব একটা দেখা যায় না। বরং তাতে চলে দায় চাপানোর খেলা। অর্থাৎ, একটি খাত থেকে আপনি অর্থ নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবেন ঠিকই, কিন্তু তাতে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করে সেটিকে টেকসই করার কোনো তাড়নাই নেই!
এভাবে, সরকার নিজেই বেসরকারি ও সরকারি চাকরিজীবীদের মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টি করে যাচ্ছে। আর এতে করে মধ্যবিত্ত শ্রেণি নিশ্চিতভাবে সংকোচিত হচ্ছে। কারণ যে পেশাভিত্তিক মানুষ এই শ্রেণিতে সবচেয়ে বেশি অবদান রাখছে, তাদেরকেই করের চাপে পিষ্ট করে ছিবড়ে করে ফেলা হচ্ছে। তো, এই শ্রেণির যদি সঞ্চয়ের পরিমাণই যথেষ্ট না হয়, তবে সে ভোগ বাড়াবে কী করে? আর ভোগই যদি না বাড়ে, তবে মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে কেন্দ্র করে অর্থনৈতিক উন্নয়ন আসবে কীভাবে? যতটুকু এখনও আসছে, সেটিই‑বা টেকসই হবে কীভাবে?
প্রতীকী ছবিআশা করি, এতক্ষণে বোঝা হয়ে গেছে যে, এ দেশে মধ্যবিত্তরা কেমন আছে! এবার তার উপযুক্ত বিশেষণ খুঁজে পেলেই হয়। তবে তা যে খুব একটা মর্যাদাকর হবে না, সেটি নিশ্চিত।
সর্বাঙ্গে ব্যথা, ওষুধ দেব কোথা!
আমাদের মাথাব্যথা হলে, আমরা তা কমানোর ওষুধ খেতে পারি। ঘাড়ে ব্যথা হলে নিশ্চয়ই খেতে হয় ভিন্ন ওষুধ। কিন্তু এ দেশে যেন যাই হোক না কেন, সেই একই বিজ্ঞাপনী মন্ত্র জপে চলা হয়–‘প্যারাসিটামল দুই বেলা!’ যদিও সেই প্যারাসিটামল ভেজালমুক্ত কিনা, তা নিয়েও থাকে প্রবল সংশয়।
আমাদের দেশে মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে কেন্দ্র করে টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়ন আনয়নের সুপরিকল্পনাই সেভাবে আসলে করা হয়নি। এর সাক্ষ্য দেয় দেশে এখনও জাতীয়ভাবে মধ্যবিত্ত শ্রেণির সংজ্ঞায়ন ও চিহ্নিতকরণের মানদণ্ডের অভাব। যদি মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে নিয়ে সরকারগুলোর ভাবনা থাকতই, তবে অনেক আগেই এ বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হতো। অথচ আমাদের পাশের দেশ ভারত এ নিয়ে পরিকল্পিতভাবে কাজ করে অনেক এগিয়ে গেছে। সেই এগিয়ে যাওয়া এতটাই যে, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো বলছে, বর্তমান পরিস্থিতিতে যেখানে চীনের মধ্যবিত্ত শ্রেণিও সংকোচিত হচ্ছে, সেখানে হয়তো একমাত্র ব্যতিক্রম হয়ে প্রবৃদ্ধি দেখাতে পারে ভারত। দেশটির জাতীয় পর্যায়ে এ বিষয়ে চিন্তাভাবনাও আছে বেশ। তাই এ বছরের বাজেটে মধ্যবিত্ত শ্রেণির ওপর করের বোঝা কমিয়ে এই শ্রেণিকে আরেকটু সুবিধা দেওয়ার আলোচনা গতি পাচ্ছে, সরকারও গুরুত্ব দিচ্ছে। আর অন্যদিকে বাংলাদেশে মধ্যবিত্তের ওপর উল্টো করের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। সুবিধা-অসুবিধা দেখা তো দূর কি বাৎ!
ছবি: পেক্সেলআসলে আমাদের দেশে মধ্যবিত্তকে কেবলই সরকারের খরচা চালানোর গৌরি সেন হিসেবে সাব্যস্ত করে ফেলা হয়েছে। এই শ্রেণি তাই এ দেশে কর জোগানোর মেশিন মাত্র। রাজনৈতিক ও প্রশাসনিকভাবে এ দেশে দুর্নীতিকে অনেকটাই স্বাভাবিকীকরণ করা হয়েছে। ফলে সুশাসন হয়ে গেছে অমাবস্যার চাঁদ। আর বিত্তভিত্তিক শ্রেণি উত্তরণকে বিভিন্ন বাধার বেড়াজালে এমনভাবে আটকে ফেলা হচ্ছে যে, এই দেশটা ক্রমে পরিণত হচ্ছে ধনী ও হাভাতের দেশে। এখানে কেউ শোবে বিশাল অট্টালিকায়, তুলতুলে নরম বিছানায়। আর বেশির ভাগের জায়গা হবে শক্ত তক্তাপোষে। তাতে শুয়ে সর্বাঙ্গে ব্যথা হয়ে একটু উঁহু-আহা করলেই মাননীয়দের অহংভরা কণ্ঠ শুনিয়ে দেবে–‘প্যারাসিটামল দুই বেলা!’ সেক্ষেত্রেও অবশ্য বাড়তি কর কেটে নেওয়া হতে পারে। তবে তা নিয়ে ট্যাঁ-ফো করা চলবে না। এ দেশে তফাতে চলা মধ্যমদের যে মুখ বুজে সব সহ্য করে যাওয়াই অদৃষ্ট!
লেখক: উপবার্তা সম্পাদক, ডিজিটাল বিভাগ, ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশন
[এই মতামত লেখকের নিজস্ব। এর সঙ্গে ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশনের প্রাতিষ্ঠানিক সম্পাদকীয় নীতিমালার কোনো সম্পর্ক নেই।]