বাংলায় একটা প্রবাদ আছে- ‘অপেক্ষায় ছিলাম সোনার ধান, পেলাম কাঁকড়া-বিছা!’ ব্যাপারটা এমন- আশা করেছিলাম পাবো মূল্যবান সোনালি ধান, কিন্তু পেলাম কাঁকড়ার আবর্জনাময় বাসা! এই প্রবাদটা এবারের বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগের (বিপিএল) সঙ্গে বেশ মানিয়ে যায়। প্রতিশ্রুতির কমতি ছিল না। জোর গলায় বলা হচ্ছিল এবার উপহার দেওয়া হবে সর্বকালের সেরা বিপিএল। দেশের রাজনৈতিক পালা-বদলের পর সবার প্রত্যাশাটাও ছিল আকাশছোঁয়া। কিন্তু বাস্তবে যা ঘটেছে, তাতে এটিকে সর্বকালের বাজে বিপিএলও বলছেন অনেকে!
অথচ আন্তর্জাতিক তারকাদের উপস্থিতি, রোমাঞ্চকর ম্যাচ, নতুন প্রতিভা উঠে আসা-সব মিলিয়ে বিপিএল বাংলাদেশের ক্রিকেটের বড় বিজ্ঞাপন। কিন্তু ২০২৫ সালে মাঠের লড়াই ছাপিয়ে আলোচনার কেন্দ্রে ছিল পারিশ্রমিক সংক্রান্ত বিতর্ক, ফিক্সিং গুঞ্জন এবং আয়োজকদের দায়িত্বহীনতা।
বিদেশি ও স্থানীয় ক্রিকেটারদের পারিশ্রমিক না পাওয়া, ফ্র্যাঞ্চাইজির অব্যবস্থাপনা এবং বিসিবির নীতিগত দুর্বলতা নিয়ে সমালোচনা তুঙ্গে। এসবের মাঝে শেষ সময়ে এসে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) সভাপতি ফারুক আহমেদ ভুল স্বীকার করলেও প্রশ্ন থেকেই যায়-এখন তার করণীয় কী? দায়িত্ব নিয়ে পদত্যাগ করবেন, নাকি শুধুই দুঃখ প্রকাশের মাধ্যমে বিতর্ক এড়িয়ে যাবেন?
বিপিএলের অন্যতম মূল উদ্দেশ্য ছিল ঘরোয়া ক্রিকেটের মানোন্নয়ন, তরুণ প্রতিভা তুলে আনা এবং বিশ্বমানের ক্রিকেটারদের সঙ্গে স্থানীয় খেলোয়াড়দের প্রতিযোগিতার সুযোগ করে দেওয়া। কিন্তু এবারের আসরে তা থেকে সরে গিয়ে নানা অনিয়ম ও বিশৃঙ্খলতার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে।
চলতি বিপিএলে সবচেয়ে বড় বিতর্কের বিষয় ছিল পারিশ্রমিক পরিশোধ না করা। একাধিক দল তাদের খেলোয়াড়দের পাওনা পরিশোধ করতে পারেনি কিংবা অনেক দেরিতে দিয়েছে। বিদেশি ক্রিকেটারদের কেউ কেউ দীর্ঘদিন অপেক্ষা করেও পারিশ্রমিক পাননি, ফলে অনেকে অনুশীলন বয়কট করেছেন, কেউ আবার ম্যাচ খেলতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। এমন অবস্থায় বিসিবির ভূমিকাও ছিল হতাশাজনক।
বিসিবির শীর্ষ কর্মকর্তারা প্রথমে বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেও বিতর্ক যখন চরমে পৌঁছে, তখন বিসিবি সভাপতি ফারুক আহমেদ দুঃখ প্রকাশ করেন। তবে দুঃখ প্রকাশ করলেই কি দায়িত্ব শেষ হয়ে যায়? বিপিএলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয়েছে, খেলোয়াড়রা তাদের প্রাপ্য টাকা পাননি, এমন অবস্থায় দুঃখ প্রকাশ করলেই কি সব মাফ হয়ে যাবে? এই প্রশ্নের উত্তর এখনো মেলেনি।
বিপিএলের এই বিশৃঙ্খলা ও অব্যবস্থাপনার বিষয়ে সিনিয়র ক্রীড়া সাংবাদিক শামীম চৌধুরী তীব্র সমালোচনা করেছেন। তিন দশকের বেশি সময় ধরে মাঠের ক্রিকেট কাভার করা এই অভিজ্ঞ সাংবাদিকের মতে, পুরো বিপিএল আয়োজনেই ছিল চরম অব্যবস্থাপনা ও দায়িত্বহীনতা।
শামীম চৌধুরী স্পোর্টস বাংলা-কে বলেন, ‘খুব বেশি তাড়াহুড়ো করে, হোমওয়ার্ক ছাড়া বিপিএল শুরু করা হয়েছে। কোনো পরিকল্পনাই ছিল না। আয়োজকরা ফ্র্যাঞ্চাইজি নির্বাচনেও চরম অদূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন। কোনো ব্যাংক গ্যারান্টি মানি রাখা হয়নি, যার ফলে ক্রিকেটারদের পারিশ্রমিক পরিশোধ নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়েছে। অথচ আগের বিপিএলগুলোতে এমনটি হয়নি। এবার ফারুক আহমেদ যখন সর্বকালের সেরা বিপিএলের প্রতিশ্রুতি দিলেন, তখন বাস্তবে সেটি হলো সর্বকালের সবচেয়ে বিতর্কিত বিপিএল!’
শামীম চৌধুরী মনে করেন, এই ব্যর্থতার দায় স্বীকার করে বিসিবি সভাপতির সরে যাওয়া উচিত। অনুসন্ধানী ক্রীড়া সাংবাদিকতায় একাধিক পুরস্কার জয়ী এই সিনিয়র সাংবাদিক বলছিলেন, ‘এখন দায়িত্ব নিয়ে পদত্যাগ করাই হবে সবচেয়ে যৌক্তিক সিদ্ধান্ত। কারণ, এত বড় একটি আয়োজনের এমন অব্যবস্থাপনার দায় তিনি আর কার ওপর চাপাবেন? নতুন সরকারও এই বিপিএল বিতর্কের কারণে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়েছে।’
পারিশ্রমিক বিতর্কের পাশাপাশি বিপিএলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয়েছে স্পট ফিক্সিংয়ের গুঞ্জনের কারণেও। গুঞ্জন উঠেছে, এবারের বিপিএলে একাধিক ক্রিকেটার স্পট ফিক্সিংয়ে জড়িত থাকতে পারেন। এমন সন্দেহের ভিত্তিতে বিসিবির দুর্নীতি দমন ইউনিট (এসিইউ) তদন্ত শুরু করেছে। তবে এখনো কোনো আনুষ্ঠানিক তথ্য প্রকাশ করা হয়নি। ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ এই বিষয়ে কঠোর অবস্থান নিয়েছেন। তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, ফিক্সিংয়ের সঙ্গে যদি কেউ জড়িত থাকে, তবে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বিপিএলের বকেয়া পারিশ্রমিক সংক্রান্ত সবকিছু খতিয়ে দেখতে বিশেষ একটি কমিটি গঠন করেছে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ। ক্রীড়া উপদেষ্টা জানালেন, পারিশ্রমিক সমস্যাসহ সবকিছুই খতিয়ে দেখবে এই সত্যানুসন্ধান কমিটি।
শামীম চৌধুরী এবারের আয়োজনে আরেকটি বিষয় নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি বলেন, ‘গেম ডেভেলপমেন্ট প্রধান (নাজমুল আবেদিন ফাহিম) বিপিএল চলাকালে বিদেশ সফরে চলে গেলে বোঝা যায়, তার সিরিয়াসনেস কতটুকু! বোর্ড সভাপতি ফারুক আহমেদ এক সময় নির্বাচক ছিলেন, অন্যজন বোর্ডের চাকুরে-কোচ। তারা এত বড় দায়িত্ব সামলাবেন কী করে? অদক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন, যার দুর্নামের ভাগিদার হতে হয়েছে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকেও।’
এখন প্রশ্ন হলো, বিসিবি সভাপতি ফারুক আহমেদ শুধু ভুল স্বীকার করলেই কি সব শেষ? নাকি বাস্তবিক কোনো ব্যবস্থা নেবেন? বিপিএলের যে করুণ দশা দাঁড়িয়েছে, তাতে তার পদত্যাগই কি সবচেয়ে যৌক্তিক সিদ্ধান্ত নয়? বিশ্লেষকরা বলছেন-সময় এসেছে দুঃখ প্রকাশের গণ্ডি পেরিয়ে কার্যকর সিদ্ধান্ত নেওয়ার।