"

নতুন রাজনৈতিক দল এনসিপি’কে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হবে

 

২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, দুপুরের পর থেকেই ঢাকার মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ জমায়েত হতে শুরু করে নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি বা এনসিপি-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে। এই দলটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন সেই ছাত্র নেতারা, যারা শেখ হাসিনার ১৫ বছরের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে সফল গণআন্দোলনের মূল সংগঠক ছিলেন।

 

বিকেলের মধ্যে, সংসদ ভবনের সামনে প্রশস্ত সড়কের এক পাশে হাজারো মানুষ ভিড় জমায়। ওই সড়কটি ওই অংশটি একটি রোড ডিভাইডারের মাধ্যমে অপর পাশ থেকে পৃথক। সেখানে ছাত্র-ছাত্রী, তরুণ-তরুণী, বৃদ্ধ-যুবকসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ উপস্থিত। কেউ শার্ট-প্যান্ট, কেউ পায়জামা-পাঞ্জাবি পরে এসেছেন। কারও মুখে দাড়ি, কারও দাড়ি নেই; কেউ কেউ বোরকা পরে এসেছেন, বোরকা ছাড়া এমন নারীও উপস্হিত। সকলেই উৎসুক চিত্তে অপেক্ষা করছেন।


সন্ধ্যার মধ্যে, জনস্রোত সড়কের দুই পাশেই ছড়িয়ে পড়ে, সংসদ ভবন থেকে খেজুরবাগান মোড় পর্যন্ত। জনতার উচ্ছ্বাস চরমে পৌঁছায় যখন নতুন দলের নেতা নাহিদ ইসলাম ঘোষণা দেন, “বাংলাদেশে ভারত বা পাকিস্তান-পন্হী রাজনীতির কোনো স্থান হবে না। আমরা আমাদের রাজনীতি ও রাষ্ট্র গড়ব একমাত্র বাংলাদেশের স্বার্থকে কেন্দ্র করে।”


ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম নেতা হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেন, “আমরা চাই পরিবারতন্ত্রের রাজনীতির চির অবসান হোক। এখানে কামারের ছেলে প্রধানমন্ত্রী হবে, কুমারের ছেলে প্রধানমন্ত্রী হবে। নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে যোগ্যতার ভিত্তিতে।”


ছাত্র নেতারা আরও অঙ্গীকার করেন যে, তারা একটি "দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্র" গড়ে তুলবেন, সাংবিধানিক স্বৈরতন্ত্র থেকে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রূপান্তর ঘটানোর মাধ্যমে। এই রূপান্তর নিশ্চিত করতে তারা রাজনৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের ওপর জোর দেন। তাদের মতে, এই পরিবর্তন বাস্তবায়নের জন্য আগামী জাতীয় নির্বাচনকে গণপরিষদ নির্বাচন হিসেবে আয়োজন করতে হবে, যাতে নতুন সংবিধান প্রণীত হতে পারে।


Adstera 720

 

মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে জমায়েতের মাধ্যমে ‘জাতীয় নাগরিক পার্টির’ (এনসিপি) আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠান মঞ্চের প্রথম সারিতে সার্জিস আলম, হাসনাত আবদুল্লাহ, সামান্তা শারমিন, হান্নান মাসুদসহ অন্যান্য নেতাবৃন্দকে দেখা যায়। ছবি: রজত তন্ময়

আগামী দিনের করণীয় কাজ


তবে এনসিপির সামনে রয়েছে বহু চ্যালেঞ্জ। দলের অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র নিশ্চিত করাই হবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ এর সদস্যরা বিভিন্ন পটভূমি থেকে আসায় মতপার্থক্য মেটাতে সময় লাগতে পারে।দলের অর্থায়ন ও নেতাদের সম্পদ ঘোষণায় স্বচ্ছতা বজায় রাখাও বড় একটি পরীক্ষা, কারণ জনসমর্থন অনেকাংশেই নির্ভর করবে তাদের আর্থিক সততার ওপর। এ ছাড়া, রাজনৈতিক সুবিধাভোগী ও লুটেরা শ্রেণির অনুপ্রবেশ ঠেকাতে হবে-- এরা দলের আদর্শিক লক্ষ্যকে বিপথে ঠেলে দিতে পারে।


তবে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে "দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্র" গঠনের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করা। নতুন সংবিধান প্রণয়নের জন্য গণপরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের উদ্যোগ নিতে হলে ব্যাপক জনসমর্থন ও অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সহযোগিতা প্রয়োজন হবে, বিশেষ করে বিএনপির। বর্তমান প্রেক্ষাপটে বিএনপি দেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল।


সাম্প্রতিক দশকগুলোতে বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর শীর্ষ নেতারা নেতৃত্বকে কেন্দ্রীয়করণ ও পারিবারিকীকরণ করেছেন। ফলে দলগুলোর অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র দুর্বল হয়ে পড়েছে। বেশিরভাগ জেলা ও কেন্দ্রীয় কমিটি গোপন ব্যালট বা নির্দিষ্ট বিধিবিধান ছাড়াই গঠিত হয়, যার ফলে একই ব্যক্তিরা বছরের পর বছর ক্ষমতায় থাকেন এবং অনেকে নিজেদের পরিবারের সদস্যদের পরবর্তী নেতৃত্বের জন্য প্রস্তুত করেন।


এই স্বচ্ছতার অভাব অনেক সময় অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বকে উসকে দেয়। কখনো কখনো দেখা দেয় সহিংস বিক্ষোভ। সংসদীয় ও স্থানীয় নির্বাচনের মনোনয়ন প্রক্রিয়াও এক ধরনের আধা-সামন্ততান্ত্রিক ধারা অনুসরণ করা হয়। তৃণমূল নেতাদের ভূমিকা সীমিত, কেন্দ্রীয় পর্যায়ের কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যক্তিই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেন।


রাষ্ট্রের সংস্কারের পাশাপাশি রাজনৈতিক দলের সংস্কারও অত্যন্ত জরুরি। দীর্ঘমেয়াদে গণতান্ত্রিক চর্চা প্রতিষ্ঠিত করা এবং পারিবারিক  আধিপত্যের অবসান ঘটানো প্রয়োজন। এনসিপির জন্য এখন সবচেয়ে বড় অগ্রাধিকার হলো মানুষের আস্থা অর্জন করা।


বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে দলগুলো বিপুল সংখ্যক পূর্ণকালীন কর্মীর ওপর নির্ভরশীল, যাদের অনেকেই বেকার।এসব কর্মীরা সাধারণত রাজনৈতিক যোগাযোগকে কাজে লাগিয়ে প্রায়শই সরকারি উন্নয়ন প্রকল্পের ঠিকাদারি কাজে অন্যায় প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে অর্থ-বিত্ত্বের মালিক বনে যায়।


এছাড়া জনসমাবেশ এবং নির্বাচন পরিচালনার জন্য বিপুল সংখ্যক লোকের প্রয়োজন হয়। সংসদ নির্বাচনের সময়, সারাদেশে প্রায় ২০০,০০০ ভোটকেন্দ্র স্থাপন করা হয়, যার জন্য একদিনে ৩০০টি আসনে প্রতিটি দলের পক্ষ থেকে অন্তত ২০০,০০০ পোলিং এজেন্ট দরকার হয়।


তবে স্মার্ট আইডি যাচাই পদ্ধতি চালুর মাধ্যমে ভোটারদের পরিচয় নিশ্চিত করতে পারলে আর পোলিং এজেন্টের প্রয়োজন হবে না। এতে পূর্ণকালীন দলীয় কর্মীদের ওপর নির্ভরশীলতা কমে যাবে দলগুলোর। নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় এমন প্রযুক্তিগত সংস্কার আনতে পারলে রাজনৈতিক দলগুলো সুবিধাবাদী ও লুটেরা শ্রেণির প্রভাব কমাতে পারবে, যারা ব্যক্তিগত স্বার্থে রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে ব্যবহার করে থাকে। এনসিপি সহ অন্যান্য রাজনৈতিক দল নির্বাচনে স্বচ্ছতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা বৃদ্ধির জন্য আধুনিক প্রযুক্তির সহায়তা নিতেই পারে।


এনসিপির উচিত রাজনৈতিক অনুদান এবং নেতাদের সম্পদ প্রকাশ্যে ঘোষণা করা। বিদ্যমান ব্যবস্থায়, রাজনৈতিক দলগুলোকে নির্বাচন কমিশনে বার্ষিক আয় ও ব্যয়ের হিসাব দাখিল করতে হয়। তবে, এসব হিসাবকে সাধারণত প্রশ্নবিদ্ধ বলে মনে করা হয়।


তাই এনসিপি যদি স্বচ্ছ ও সক্রিয় অবস্থান গ্রহণ করে, তবে তারা নিজেদের অন্যান্য দলের চেয়ে আলাদাভাবে উপস্থাপন করতে পারবে এবং মানুষের আস্থা অর্জনের একটি বিরল সুযোগ তৈরি হবে।


নতুন সংবিধান প্রণয়নের জন্য দলটি যে গণপরিষদের কথা বলছে, তা বাস্তবায়নের জন্য ব্যাপক জনমত ও রাজনৈতিক দলগুলোর সমঝোতা প্রয়োজন। মনে রাখা ভালো যে, এই মুহূর্তের রাজনীতির বড় অংশীজন বিএনপি ২০২৩ সালের জুলাই মাসে ৩১ দফার রাষ্ট্র সংস্কার প্রস্তাবনা প্রকাশ করেছে।


আগামী জাতীয় নির্বাচন এনসিপির জন্য হতে যাচ্ছে একটি ‘অ্যাসিড টেস্ট’। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ইতোমধ্যেই জানিয়েছে এই বছরের ডিসেম্বর অথবা আগামী বছরের জুনের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে।


রাজনীতিবিদদের জন্য রাজনীতি কঠিন করে তোলার সুযোগ?


এনসিপি যদি সত্যিকার অর্থেই দলের গঠন ও পরিচালনার ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা দেখাতে পারে, তবে তা এ সময়ের রাজনৈতিক নেতাদের জন্য রাজনীতি কঠিন হয়ে উঠবে।


বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিসরে বহুল আলোচিত একটি উক্তি হলো— "আমি রাজনীতিবিদদের জন্য রাজনীতি কঠিন করে তুলবো"। উক্তিটি জিয়াউর রহমানের বলে বলা হয়ে থাকে। জিয়াউর রহমান হচ্ছেন বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা এবং সাবেক সেনাপ্রধান। তিনি ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সমর নায়কও।


১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) গঠিত হয়েছিল। এরকম সময়ে জিয়াউর রহমান এই মন্তব্য করেছিলেন বলে মনে করা হয়। এর মাধ্যমে তিনি ইঙ্গিত দিয়েছিলেন যে, রাজনীতি আর অভিজাতদের ড্রইং রুমে সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছাবে।


অনুষ্ঠানে দেশের বিভিন্ন জেলা ও ঢাকার বিভিন্ন থানা থেকে জাতীয় নাগরিক কমিটি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা যোগ দিয়েছেন।

অনুষ্ঠানে দেশের বিভিন্ন জেলা ও ঢাকার বিভিন্ন থানা থেকে জাতীয় নাগরিক কমিটি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা যোগ দিয়েছেন। ছবি: রজত তন্ময়

বাঙালি জাতীয়তাবাদের পরিবর্তে অন্তর্ভূক্তিমূলক ও আধুনিক বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ ধারণা প্রবর্তনই নয়, জিয়াউর রহমান ভিন্ন ভিন্ন ক্ষেত্র থেকে মানুষকে একত্রিত করে তার দল গড়ে তোলেন। তিনি ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধবিরোধী কার্যকলাপের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক শক্তিসহ সকল পক্ষকে রাজনীতিতে অংশগ্রহণের সুযোগ দেন। এর মাধ্যমে দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্রের নতুন যুগের সূচনা হয়।


তবে এ নিয়ে সমালোচনাও রয়েছে। জিয়ার সমালোচকরা বলেন, তিনি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার পরিবর্তে বিভক্ত করেছেন। আওয়ামী লীগ নেতা তোফায়েল আহমেদ ২০০৯ সালের ১৬ মার্চ সংসদে বলেন, জিয়া দেশকে বিভক্ত করে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করেছেন। তিনি আরও বলেন, জিয়ার সেই উক্তি— 'আমি রাজনীতিবিদদের জন্য রাজনীতি কঠিন করে তুলবো'—বাংলাদেশের রাজনীতিকে কলুষিত করেছে।


নাহিদ ইসলাম যখন তার উদ্বোধনী ভাষণের শেষে বলেন, "এখনই সময়—নতুন স্বপ্ন দেখার, নতুন পথ গড়ার, নতুন বাংলাদেশ নির্মাণের!", তখন এটি স্পষ্ট হয় যে, এনসিপি’র জন্য সামনে রয়েছে দীর্ঘ ও কণ্টকাকীর্ণ পথ।


সবচেয়ে ভালো কৌশল হতে পারে লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য একটি সুস্পষ্ট সময়রেখা নির্ধারণ করা—হয়তো পরবর্তী দশ বছর। যদি দলটি ধৈর্য্য ধরে এবং সততা নিশ্চিত করে, তবে এটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিসরে একটি জুতসই শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারবে।


রাজনীতি টেস্ট ম্যাচের মতো—ওয়ানডে বা টি-টোয়েন্টির মতো নয়।



(নিবন্ধটি ইংরেজি থেকে অনূদিত।)


লেখক: সহযোগী সম্পাদক, ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশন


[এই মতামত লেখকের নিজস্ব। এর সঙ্গে ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশনের প্রাতিষ্ঠানিক সম্পাদকীয় নীতিমালার কোনো সম্পর্ক নেই।]

Previous Post Next Post

Random Manga

Ads

نموذج الاتصال