বুধবার প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক করে বিএনপির ৮ সদস্যের প্রতিনিধি দল। বৈঠকে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সই করা এই চিঠিটি প্রধান উপদেষ্টাকে দেওয়া হয়।
চিঠিতে গণতন্ত্র, সংস্কার এবং শাসনব্যবস্থা নিয়ে বিএনপির অবস্থান তুলে ধরে দ্রুত গণতান্ত্রিক অধিকার পুনরুদ্ধারের আহ্বান জানানো হয়েছে।
অধ্যাপক ইউনূসকে দেওয়া চিঠিতে বিএনপি মহান মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে নেতৃত্বদানকারী বা সক্রিয় অংশীদার হিসেবে নিজেদের ভূমিকার কথা উল্লেখ করে। দলটি জানায়, জনগণের জন্য এসব লড়াইয়ের ফল কার্যকর করতে সর্বদা প্রচেষ্টা চালিয়েছে তারা। বিএনপি মনে করে, জনগণের স্বার্থরক্ষা ও স্থায়ী কল্যাণের জন্য গণতান্ত্রিক শাসনের কোনো বিকল্প নেই। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া।
চিঠিতে পূর্ববর্তী ফ্যাসিস্ট সরকারের ‘আগে উন্নয়ন, পরে গণতন্ত্র’ নীতির সমালোচনা করে এটিকে গণতান্ত্রিক অধিকার হরণের কৌশল হিসেবে উল্লেখ করা হয়। একইভাবে, কিছু ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর ‘আগে সংস্কার, পরে গণতন্ত্র’ ধারণাকেও ভ্রান্ত যুক্তি হিসেবে প্রত্যাখ্যান করা হয়।
বিএনপি লিখেছে, আজ যারা সংস্কারের কথা বেশি বেশি বলেন এবং বিএনপিকে সংস্কারের বিপক্ষের শক্তি বলে চিহ্নিত করার অপচেষ্টা করছেন তাদেরকে আমাদের ভিশন-২০৩০ এবং রাষ্ট্র কাঠামো মেরামতের ৩১ দফা কর্মসূচিতে যেসব সংস্কারের প্রস্তাব করা হয়েছে ও যে সব পরিবর্তনের আকাঙক্ষা ব্যক্ত করা হয়েছে তার প্রতি দৃষ্টি দিতে বলছি।
৩১ দফায় বিএনপি আরও বলেছে, এসব প্রস্তাবের চেয়ে ভালো কোনো প্রস্তাব কেউ দিলে জনস্বার্থে তা সাদরে গ্রহণ করা হবে। অর্থাৎ সংস্কারের চলমান প্রক্রিয়া বিএনপির ঘোষণারই অংশ।
বিএনপি স্পষ্ট করে যে সব পরিবর্তনই সংস্কার নয়; সংস্কার হতে হবে গঠনমূলক ও ইতিবাচক। দলটি সকল প্রস্তাব নিয়ে যুক্তিগ্রাহ্য আলোচনাকে স্বাগত জানায়। জনগণের ভোটাধিকার ও রাষ্ট্রের মালিকানা প্রতিষ্ঠায় বিলম্বের কৌশলকে বিএনপি সমর্থন করে না, এটিকে রাজনীতি ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানকে অপ্রাসঙ্গিক করার প্রচেষ্টা হিসেবে দেখে।
চিঠিতে দেশ ও জনগণের স্বার্থে জনগণের সম্মতি নিয়ে ৩১ দফায় বর্ণিত এবং ঐকমত্যে গৃহিত সব সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়নে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ বিএনপি সকলের সহযোগিতা প্রত্যাশা করে।
‘ইতোপূর্বে গত ২১ নভেম্বর ২০২৪ এবং ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ আমরা আপনাকে লিখিতভাবে আমাদের কিছু উদ্বেগের কথা এবং কিছু পরামর্শ জানিয়েছিলাম। দুর্ভাগ্যক্রমে সেসব বিষয়ে আপনাদের অবস্থান আমরা জানতে পারিনি, কিংবা এসব বিষয়ে কোনও আলোচনাও হয়নি।’
‘উল্লেখ্য যে ফ্যাসিস্ট সরকারের দ্বারা বৈষম্যের শিকার ও পদোন্নতি বঞ্চিত প্রশাসন ক্যাডারের ৭৬৪ জন কর্মকর্তাকে সচিবসহ বিভিন্ন পদে ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি দেওয়া হলেও তাদের একজনকেও এখনও পর্যন্ত পদায়ন না করে পতিত সরকারের অপশাসনের দোসর ও সুবিধাভোগীদের দিয়েই রাষ্ট্র পরিচালনা করার ফলে সরকারের কার্যক্রম ও উন্নয়ন প্রয়াস ব্যাহত হচ্ছে। অন্যান্য ক্যাডারে বৈষম্যের শিকার কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরও ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি ও পদায়ন নিশ্চিত করা যৌক্তিক বিধায় তা দ্রুত সম্পন্ন করা জরুরি বলে আমরা মনে করি।’
চিঠিতে বলা হয়, ‘আমরা দৃঢ়ভাবে মনে করি যে যেকোনও রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহী ও তার সরকারের বক্তব্য ও মতামতে সমন্বয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সম্প্রতি এর কিছু ব্যতিক্রম আমাদের উদ্বিগ্ন করেছে। আমরা আপনাকে সমর্থন জানিয়েছি এবং আপনার ওপরই আস্থা রাখতে চাই। কিন্তু আপনার সরকারের কিছু ব্যক্তি এবং আপনাকে সমর্থনকারী বলে দাবিদার কিছু ব্যক্তি ও সংগঠনের প্রকাশ্য বক্তব্য ও অবস্থান জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছে। আশা করি আপনি এসব বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন।’
বিএনপি বলে, ‘আমরা আগেও বলেছি এবং এখনও বলতে চাই যে দেশের জনগণকে তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার যে মহান দায়িত্ব আপনার ওপর অর্পিত হয়েছে—যত দ্রুত সম্ভব আপনি তা পালন করবেন। একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য যেসব আইন, বিধি, বিধান সংস্কারে এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোতে যেসব পরিবর্তন জরুরি, তা সম্পন্ন করার মাধ্যমে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্ভব বলে আমরা মনে করি।’
‘এ ব্যাপারে ইতোপূর্বে আপনার সঙ্গে সাক্ষাৎকালে প্রদত্ত আপনারই আশ্বাস অনুযায়ী আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে অবিলম্বে সুনির্দিষ্ট নির্বাচনি রোডম্যাপ ঘোষণার প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণের জন্য আমরা আপনার প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি। আমরা এনআইডি প্রকল্প নির্বাচন কমিশনের অধীনে রাখার এবং নির্বাচনি এলাকা পুনর্নির্ধারণের বিষয়ে আইনি জটিলতা দ্রুত নিরসনেরও প্রস্তাব করছি।’
‘একইসঙ্গে পতিত ফ্যাসিবাদী দল ও সেই দলীয় সরকারের সঙ্গে যারাই যুক্ত ছিল—তাদের বিচার দ্রুত করে রাজনীতির ময়দানকে জঞ্জালমুক্ত করার; জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানে নিহত ও আহতদের ক্ষতিপূরণ ও সুচিকিৎসা দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার এবং দ্রব্যমূল্য ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন এবং অর্থনৈতিক কার্যক্রমে গতিশীলতা আনার অধিকতর উদ্যোগ নেওয়ার জন্য আমরা আহ্বান জানাচ্ছি। একইসঙ্গে ১/১১-এর অবৈধ সরকার এবং পতিত ফ্যাসিবাদী সরকারের আমলে দায়ের করা সব মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলা অনতিবিলম্বে প্রত্যাহারের দাবি পুনর্ব্যক্ত করছি।’
‘আমরা আপনার নেতৃত্বাধীন সরকারের সব ইতিবাচক কর্মপ্রয়াসে সমর্থন প্রদান অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত পুনর্ব্যক্ত করে প্রয়োজনীয় সংস্কার দ্রুত সম্পন্ন করে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ যথাশিগগির ঘোষণার মাধ্যমে জনমনে সৃষ্ট সব বিভ্রান্তি অবসানের আহ্বান জানাচ্ছি।’
চিঠিতে ‘আপনার আস্থাভাজন’ উল্লেখ করে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সই করেন।
Tags
আন্তর্জাতিক