
সুনামগঞ্জ, যার বুক জুড়ে লালিত হয় বোরো ধানের সোনালি স্বপ্ন। দেশের ‘বোরো ধানের ভান্ডার’ খ্যাত এই জেলার হাওর অঞ্চলজুড়ে সারা বছরের খাদ্য, সন্তানদের লেখাপড়া, বিয়ে-শাদি ও সংসার চলে একমাত্র ফসলকে ঘিরে। ধান উঠলে চাঙা হয় হাওরের প্রান্তিক অর্থনীতি। কিন্তু এবার সেই সোনালি স্বপ্নের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে অকালব ন্যার অন্ধকার আশঙ্কা।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, চলতি মৌসুমে জেলার ১২ উপজেলার ১৩৭টি ছোট-বড় হাওরে বোরো চাষাবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ২ লাখ ২৩ হাজার ৪১০ হেক্টর জমিতে। তবে বাস্তবে চাষ হয়েছে তার চেয়েও বেশি ২ লাখ ২৩ হাজার ৫০২ হেক্টর জমিতে। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে প্রায় ১৩ লাখ ৯৬ হাজার ৮০ মেট্রিক টন ধান। যার বাজার মূল্য আনুমানিক ৫ হাজার ২ কোটি ৮০ লাখ টাকা।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মোস্তফা ইকবাল আজাদ ঢাকা পোস্টকে জানান, ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত হাওরের ১৫ হাজার ৩২০ হেক্টর জমির ধান কাটা হয়েছে। মাঠে বর্তমানে কাজ করছে ৭৩ হাজার শ্রমিক, ১৬০টি কম্বাইন হারভেস্টার ও ১৫টি রিপার। ধান দ্রুত কাটার সুবিধার্থে জেলা কৃষি বিভাগের সব কর্মকর্তার ছুটি বাতিল করা হয়েছে।
তবে বাস্তবতায় দেখা যাচ্ছে, এসব উদ্যোগ অনেক ক্ষেত্রেই পর্যাপ্ত নয়। দিরাই উপজেলার কৃষক কামাল মিয়া বলেন, আমি কিছু জমিতে ধানের চাষ করেছি। আমার জমির ধান এখনো পুরোপুরি পাকেনি। আর কয়েকদিন পর যদি বৃষ্টি নামে, তবে একটি ধানও গোলায় তুলতে পারবো না।
তাহিরপুর উপজেলার কৃষক রহিম উল্লাহ বলেন, ভারতের চেরাপুঞ্জিতে বৃষ্টি মানেই আমাদের হাওরে পানি বাড়বে। এতো কষ্ট করে ধান করি, কিন্তু এক রাতেই যদি সব ডুবে যায়, তাহলে তো মাথায় হাত।
ধর্মপাশার কৃষক আনোয়ার হোসেন বলেন, আমার জমির ধান মোটামুটি পাকছে। কিন্তু সময়মতো যদি মেশিন বা শ্রমিক না পাই, তাহলে ধান নষ্ট হয়ে যাবে। উপরন্তু হাওর থেকে ধান ঘরে তুলতে এখনও কোনো নৌকার ব্যবস্থা করতে পারিনি।
সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার কৃষক ছদর আলী বলেন, আমাদের দিকে অনেক জমির ধান এখনো আধা-পাকা। কিন্তু পাউবোর বার্তা শুনে কেউ আর বসে থাকতে পারছে না। যে যেভাবে পারছে পাকা ধান কাটছে। কিন্তু সমস্যাটা হচ্ছে, মেশিন আর শ্রমিক মিলছে না। আবার বাড়ি থেকে ধান এনে শুকানোর জায়গাও নেই। সব মিলিয়ে খুব বাজে পরিস্থিতি হচ্ছে দিন দিন।
সুনামগঞ্জের অর্থনৈতিক ভিত্তি মূলত এই বোরো ধান ঘিরেই। ফসল ঘরে তুলতে পারলেই হাওরের মানুষের ঘরে হাসি ফোটে। সন্তানদের স্কুলে পাঠানো যায়, সংসারে ফেরে স্বস্তি। এই ধান শুধু খাদ্য নয়, এটাই তাদের ভবিষ্যতের ভরসা। আর সেই ধান ঘিরেই এখন হাওরবাসীর চোখে ভয়, আকাশের দিকে তাকিয়ে তারা প্রার্থনায়, যেন প্রলয় তার আগমন জানান না দেয় ফসল ঘরে ওঠার আগেই।
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সুনামগঞ্জ কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মামুন হাওলাদার ঢাকা পোস্টকে জানান, এবার সুনামগঞ্জে অকাল বন্যা ও পাহাড়ি ঢলের কবল থেকে বোরো ফসল রক্ষায় ৫০টি হাওরে ৬৮৭টি প্রকল্পে ৫৯৬ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ সংস্কার ও নির্মাণ করা হয়েছে। এতে ব্যয় ধরা হয়েছিল ১২৭ কোটি টাকা। কিন্তু ১৫ থেকে ২১ এপ্রিল পর্যন্ত সুনামগঞ্জ ও উজানে ভারতের মেঘালয়ে মাঝারি থেকে ভারী বৃষ্টির পূর্বাভাস রয়েছে। এতে পাহাড়ি ঢল নেমে সুনামগঞ্জের নিম্নাঞ্চলে পানি বৃদ্ধির শঙ্কা তৈরি হয়েছে, যা হাওরের ধান কাটা এবং ঘরে তোলার প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করতে পারে। কিন্তু পানি বাড়লেও বিপদসীমা অতিক্রম করবে ন বলে আমরা আশাবাদী।